স্বাপ্নিক এবং সংগ্রামী ডাক্তার হারিছ আলী

ডা. হারিছ আলী (৩১মে ১৯৪১ – ২০ আগস্ট ২০১৩) একজন বাংলাদেশী রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, কবি, লেখক, সাংবাদিক, বিদ্যোৎসাহী সমাজ সংস্কারক, মহান মুক্তিযুদ্ধে ৫ নং সেক্টরের অন্যতম রাজনৈতিক সংগঠক এবং চেলা-ভোলাগঞ্জ সাব-সেক্টরে প্রবাসী সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত রেজিমেন্টাল মেডিক্যাল অফিসার। 

জন্ম, পরিবার এবং বেড়ে ওঠা

ডা. হারিছ আলী সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক থানার অন্তর্গত দেবের গাঁওয়ে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হাজি ইউসুফ আলী (১৮৮২-১৯৭২) এবং মাতার নাম গোলাপজান বিবি (১৯০০-১৯৭৬)। দশ ভাই-বোনের মধ্যে হারিছ আলী ছিলেন ষষ্ঠ। 

ডা. হারিছের পিতা হাজী ইউসুফ আলী ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন এবং ধর্মপরায়ণ মানুষ। ছাতকজুড়ে ন্যায়পরায়ণ সালিশ ব্যক্তিত্ব হিশেবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে পরহেজগার হলেও আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ এবং প্রসারের ব্যাপারে হাজী ইউসুফ আলী অত্যন্ত উৎসাহী ছিলেন। তিনি পাঠশালায় পড়াশোনা করেন। পরে মক্তবে আরবী ফার্সী ভাষা শিখেন। বাড়িতে পুঁথি পাঠ করতেন, যা হয়তো বালক হারিছের কল্পনার জগত প্রসারিত করেছিল। 

শিক্ষা

হারিছ আলী ১৯৬৩ সালে সিলেট মেডিক্যাল স্কুল থেকে এলএমএফ ডিগ্রি লাভ করেন। তখন পর্যন্ত দেশে মাত্র একটি মেডিক্যাল কলেজ ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ। বাকি সবকটি ছিল মেডিক্যাল স্কুল। মিটফোর্ডস্থ সলিমুল্লাহ থেকে শুরু করে সিলেট, চট্রগ্রাম, ময়মনসিংহসহ বাদবাকি অঞ্চলে শুধু মেডিক্যাল স্কুল ছিল। ছাত্ররা প্রথমে চার বছরের এলএমএফ ডিগ্রি লাভ করতো। তারপর আগ্রহীরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হতো। হারিছ আলীর ব্যাচের ছাত্ররা ১৯৬০-৬৩ আন্দোলন করে দেশের সমস্ত মেডিক্যাল স্কুলকে মেডিক্যাল কলেজে রূপান্তর করেছিল। সিলেটে এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ডা. দেওয়ান নূরুল হোসেন চঞ্চল এবং ডা. হারিছ আলী। দু’জন ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং রাজনৈতিক সহকর্মী। দেশব্যাপী আন্দোলনের ফলে ১৯৬৪ সালে সমস্ত মেডিক্যাল স্কুল মেডিক্যাল কলেজে রূপান্তরিত হয়। এভাবে সিলেট মেডিক্যাল স্কুলও মেডিক্যাল কলেজে রূপ নেয়। 

১৯৬৮ সালে হারিছ আলী মিটফোর্ডস্থ সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তাঁর চূড়ান্ত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। ২৫ মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনি আক্রমণ করলে সংগত কারণেই হারিছ আলী পরীক্ষা না দিয়ে রণাঙ্গনে চলে যান। দেশমাতৃকার মুক্তির জন্যে গলায় তুলে নেন স্টেথোসকোপ। যুদ্ধের নয় মাস আহত মুক্তিযোদ্ধা এবং হাজার হাজার শরণার্থীর চিকিৎসা করেন। অন্যদিকে একই সময়ে রাজনৈতিক নেতা হিশেবে অংশগ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সাংগঠনিক কর্মকান্ডে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে হারিছ আলী সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হোন। সেখান থেকে ডিপ্লোমা ইন ট্রপিক্যাল মেডিসিন এন্ড হাইজিন (ডিটিএমএন্ডএইচ) বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। এখান থেকে হৃদরোগ বিষয়েও উচ্চতর প্রশিক্ষণ নেন। সেকালে হৃদরোগের চিকিৎসার জন্যে উদ্ভাবিত বিশ্বের সর্বাধুনিক যন্ত্র ইসিজি মেশিন নিয়ে ডা. হারিছ আলী মানুষের সেবা করবার জন্যে ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। 

কর্মজীবন

পেশায় চিকিৎসক হলেও দেশে-বিদেশে সবাই জানেন, ডা. হারিছ আলীর নেশা ছিল রাজনীতি এবং মানুষের সেবা করা। আরবী ‘হারিছ’ শব্দটির অর্থ হলো ‘স্বেচ্ছাসেবক’। হারিছ আলীর নামের সঙ্গে তাঁর সমগ্র জীবনের কর্মকান্ড যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। 

১৯৬৩ সালে এলএমএফ পাশ করার পর হারিছ আলী সরকারী হাসপাতালের চাকুরিতে যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম পোস্টিং হয় মাদারিপুর মহকুমা সদর হাসপাতালে। সেখানে কিছুদিন কাজ করেন। তারপর তাঁকে বদলি করা হয় হবিগঞ্জে। এখানেও বছর দেড়েক থাকেন। এরপর ১৯৬৭ সালে কিছুদিন সিলেট সদর হাসপাতালে চাকুরি করেন। তারপর চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে প্রাইভেট প্রেকটিস শুরু করেন।  ১৯৬৮ সালে সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হোন। তাহলে আমরা দেখছি, হারিছ আলী মাত্র বছর চারেক সরকারী হাসপাতালে চাকরি করেন। স্পষ্টতই সারা জীবন চাকরি করে থিতু হওয়ার ইচ্ছে তাঁর ছিল না। কারণ তাঁর মনপ্রাণ জুড়ে ছিল রাজনীতি এবং দেশ ও মানুষের সেবা করার অদম্য বাসনা। এবং সেই কাজ করেই তিনি আনন্দ লাভ করেন।

রাজনীতি

রাজনীতি এবং সমাজসেবার জনেই যেন হারিছ আলীর জন্ম হয়েছিল। ১৯৫২ সালে সুনামগঞ্জে হাজী মকবুল পুরকায়স্থ (এইচএমপি) এমই স্কুলে  ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়ণকালে ভাষা আন্দোলনের মিছিল-মিটিং-পিকেটিংয়ে যোগ দেয়ার মাধ্যমে রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি হয়। ১৯৫৩ সালে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হোন সরকারী জুবিলী উচ্চবিদ্যালয়ে। এখানেও তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড অব্যাহত থাকে। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে হারিছ আলী খুদে ছাত্রকর্মী হিশেবে প্রচারণায়, মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীদের পক্ষে ছাতকে-সুনামগঞ্জে  প্রচারণা করেন। সুনামগঞ্জে তার ইস্কুল সহপাঠীদের অন্যতম ছিলেন ছাতক-দোয়ারা আসনে তিন বারের সাংসদ আবুল হাসনাত আবদুল হাই। ইনি ছিলেন ছাতকের আরেক কৃতী সন্তান ‘৭০এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে বিজয়ী সাংসদ জননেতা মোহাম্মদ আবদুল হকের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। হারিছ আলী এবং আবুল হাসনাত ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, মানিক-জোড়। জুবিলী স্কুলে অধ্যয়ণকালে তারা দু’জনেই রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠেন। জননেতা মোহাম্মদ আবদুল হক হারিছ আলীকে আপন ছোট ভাইয়ের মতো স্নেহ করতেন। 

অত:পর সুনামগঞ্জের পাঠ চুকিয়ে হারিছ আলী সিলেট শহরে আসেন। প্রথমে ভর্তি হোন ঐতিহবাহী এমসি কলেজে। ‘৫৯ সালে ভর্তি হোন সিলেট মেডিক্যাল স্কুলে। সিলেটে আসার পর শুরু থেকেই হারিছ আলী রাজনীতিতে পুরোদস্ত্তর সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ততদিনে ফিল্ড মার্শাল একনায়ক আইয়ূব শাহীর রাজত্ব শুরু হয়েছে। কিন্ত্ত তার সিংহাসন কণ্ঠকমুক্ত ছিল না। ধীরেধীরে তার বিরুদ্ধে বাঙালিদের আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। হারিছ আলী সিলেট শহরে সামনের কাতারে থেকে সেই আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। আইয়ুব খানের সিলেট সফরকালীন যেদিন সার্কিট হাউসের সামনে তার উপর জুতা নিক্ষেপ করা হয়, সেই বিক্ষোভ-মিছিলে হারিছ আলীও ছিলেন। 

সিলেটে আসার অল্পদিনের মধ্যে হারিছ আলী চলমান ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা হয়ে ওঠেন। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে নির্ভীক তরুণ হারিছ আলী ছিলেন সম্মুখসারিতে। আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন চলাকালে তার নামে মামলা হয়। বেশ কিছুদিন তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।

ইতোমধ্যে হারিছ আলী মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতে পেরেছেন, পাকিস্তান রাষ্ট কাঠামোর মধ্যে বাস করে বাঙালি জাতি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করতে পারবে না। সেজন্যে পাঞ্জাবী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তার মনে অসন্তোষ-ঘৃণা দানা বেঁধে ওঠে।

একবার মেডিক্যাল স্কুলে পাঞ্জাবী এক ছাত্রের সঙ্গে বাঙালি ছাত্রদের বচসা হয়। পাঞ্জাবী ছাত্রটি সিলেট ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে পাঞ্জাবী সেনা কর্মকর্তাদের নিকট নালিশ করে। পরদিন কয়েক ট্রাক সৈন্য এসে মেডিক্যাল স্কুল ঘেরাও করে। বাঙালি ছাত্রদের কলেজ মাঠে জড়ো করে। লাইন করে দাঁড় করায়। অত:পর তাদেরকে এই বলে শাসায়, আরেকবার যদি বাঙালি ছাত্ররা পাঞ্জাবী ছাত্রটির সঙ্গে ‘বেয়াদবি’ করে তাহলে এর পরিণতি খুব খারাপ হবে। বাঙালি ছাত্ররা চুপচাপ পাঞ্জাবী সৈনদের ধমকি হজম করে যায়। কিন্ত্ত অমিতসাহসী হারিছ আলী সেটা মেনে নিতে পারেননি। ভেতরে ভেতরে ফুঁসছেন। হঠাৎ লাইন ভেঙ্গে তিনি ধীর পায়ে হেঁটে পাঞ্জাবী সেনা কর্মকর্তাদের দিকে এগিয়ে যান। সেটা দেখে মাঠভর্তি মেডিকাল ছাত্ররা স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। করছে কী হারিছ! কিন্ত্ত হারিছ আলী অকুতোভয়ে এগিয়ে যান। সেনা কর্মকর্তাদের মুখোমুখী দাঁড়ান। তাদেরকে বলেন, দু’জন ছাত্রের মধ্যে সংঘটিত তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্কুলের সকল ছাত্রের সঙ্গে যে আচরণ করা হচ্ছে, সেটা অন্যায়। পাঞ্জাবি এবং বাঙালি ছাত্রদের মধ্যে সামান্য বচসা হয়েছে। বাঙালি ছাত্ররা এমন কোন অন্যায় করেনি। সৈন্যদের এ আচরণ লঘু পাপে গুরু শাস্তি দানের মতো বিষয়। সিনিয়র পাঞ্জাবী কর্তা নিজেও হারিছ আলীর এমন সাহস দেখে হতবাক হয়ে পড়েন। বিস্মিত হয়ে তার নাম-ধাম জানতে চান। অত:পর ছাত্রদের ছেড়ে দেন। সেদিন থেকে সমস্ত মেডিক্যাল স্কুলে হারিছ আলীর নাম ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনাটি আমরা জানতে পেরেছি সিলেট মেডিক্যালে তাঁর সহপাঠী ডা. আবদুল হকের একটি লেখা থেকে। তাহলে আমরা দেখি, ছাত্রজীবনেই হারিছ আলীর মধ্যে নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলী পরিলক্ষিত হয়। 

১৯৬১-৬২ সালে সিলেট মেডিক্যাল স্কুল ছাত্র-সংসদের নির্বাচনে হারিছ আলী জিএস প্রার্থী ছিলেন। তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হোন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আকমল হোসেন (পরে ডাক্তার) ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

১৯৬১-৬৪ সালে সিলেটে বিশ্ববিদালয় স্থাপনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। সে আন্দোলনেও হারিছ আলী নেতৃ্স্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৩ সালে এ উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠিত হয়। সেটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন হারিছ আলী। তাছাড়া ছয় দফা,  ‘৬২র শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে সিলেট শহরে হারিছ আলী অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজেও হারিছ আলী রাজনীতিতে পুরোদস্ত্তর সক্রিয় ছিলেন। এখানে ১৯৭১এর ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হারিছ আলী ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে জিএস প্রার্থী হোন। মাত্র দশ ভোটের ব্যবধানে হেরে যান। তাঁর প্যানেলের (ডা.) সালাউদ্দিন ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। 

‘৭১এর রক্তঝরা মার্চে হারিছ আলী ছিলেন ঢাকায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের জনসভায় সহপাঠী এবং ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়ে যোগ দেন। মিটফোর্ডের কলেজ হোস্টেল থেকে পায়ে হেঁটে রেসকোর্স ময়দানে হাজির হয়েছিলেন। মঞ্চের খুব কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনেন। এ বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হারিছ আলী তাঁর একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণ দিয়ে জনসভায় উপস্থিত দশ লাখ মানুষকে যেন দশ লাখ যোদ্ধা বানিয়ে ছেড়ে দিলেন!’ 

১৯৭৫ সালে ডা. হারিছ আলী সিলেট জেলা রেড ক্রিসেন্ট (তখন ছিল ক্রস) সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। 

১৯৭৬ সালের ২ জানুয়ারী ডা. হারিছ আলী চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্যে বিলাত গমন করেন। উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করে এবং প্রায় ছ’বছরের প্রবাসজীবন শেষে ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে জন্মভূমিতে ফিরে আসেন। 

বিলাতে ছ’বছরের প্রবাসজীবন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের জন্যে অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং তাৎপর্যপূর্ণ। এ সময় তিনি যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ‘৭৫এর ১৫ আগস্টের মর্মন্ত্তদ ঘটনার পর দেশে-বিদেশে আওয়ামীলীগের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে। দলে দলে নেতাকর্মীরা দল ত্যাগ করছে বা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে বা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সেই সময় লন্ডনের বাংলা টাউন খ্যাত ব্রিকলেনে প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। বিরোধী পক্ষের লোকজন বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের অনুসারীরা তেড়ে আসতো মারার জন্যে। এমনকি ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর স্মরণে বাঙালিদের বাড়িঘরে বা মসজিদে মিলাদের আয়োজন করলেও প্রতিপক্ষের লোকজন তা বানচাল করার উদ্দেশ্যে হাঙ্গামা বাঁধাতো। সেই অবস্থায় দেখা গেল পুরো লন্ডনে মাত্র ২০/২৫ জন নেতাকর্মী শক্ত হাতে আওয়ামীলীগের ঝান্ডা আঁকড়ে আছেন। ডা. হারিছ আলী ছিলেন তাদের অন্যতম প্রধান নেতা। ততদিনে বঙ্গবন্ধুর দু’কন্যাও লন্ডনে এসে বাস করতে শুরু করেছেন। তাঁদের সঙ্গে ডা. হারিছ পরিচিত হোন এবং কিছুদিনের মধ্যে দুই বোনের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন।

উল্লেখ্য সেই সময়ে যুক্তরাজ্যে শুধু মূল সংগঠন আওয়ামীলীগের শাখা ছিল। যুবলীগ বা মহিলা লীগ ছিল না। বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার সঙ্গে পরামর্শ করে ডা. হারিছ আলী যুববলীগ এবং মহিলা লীগের শাখা প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেন। অবশেষে ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্য যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের দিন দেখা গেল নেতাকর্মীরা ভালোবেসে ডা. হারিছ আলীকে যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত করেন। কিছুদিনের মধ্যে মহিলা লীগও প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংগঠন প্রতিষ্ঠার পশ্চাতেও ডা. হারিছ আলী মূল ভূমিকা পালন করেন। যুবলীগ প্রতিষ্ঠার পর যুক্তরাজ্যে ঝিমিয়ে পড়া আওয়ামীলীগ আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে। নেতাকর্মীরা আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। সাংগঠনিকভাবে আওয়ামীলীগ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। 

১৯৮০ সালে যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগ, যুবলীগসহ সমস্ত অঙ্গ সংগঠন সিদ্ধান্ত নেয় সে বছর ১৫ আগস্ট উপলক্ষে লন্ডনে বিশাল শোকসভার আয়োজন করবে। এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিশেবে বক্তৃতা করবেন। উল্লেখ্য, ‘৭৫এর পর তখনও শেখ হাসিনা প্রকাশ্য রাজনীতিতে যোগ দেননি। আওয়ামীলীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হননি। জননেত্রী হননি। তাই বলা যায়, সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার জননেত্রী হয়ে ওঠার প্রথম এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

লন্ডনের আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনাকে ইয়র্ক হলের সভায় নিয়ে যাচ্ছেন। সর্ব ডানে ডাঃ হারিছ আলী। ১৬ আগস্ট ১৯৮০

অবশেষে জনসভা অনুষ্ঠানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীরা জনসভাকে সফল করার জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। কেউ কেউ পরামর্শ দেন ছোট হলে অনুষ্ঠান করার জন্য, পাছে যথেষ্ঠ লোকসমাগম না হয়। কিন্ত্ত ডা. হারিছ আলীর নেতৃত্বে যুবলীগ বিরাট কোন হলে জনসভা করার পক্ষে মতামত দিলেন। তারা সবাইকে আশ্বস্ত করেন যে বিরাট হল হলেও সমস্যা নাই। তারা হল ভরতি করতে পারবে। শেষ পর্যন্ত পূর্ব লন্ডনের বেথনাল গ্রীনের ঐতিহাসিক ইয়র্ক হলে জনসভা করার সিদ্ধান্ত হয়। যুবলীগকে দায়িত্ব দেয়া হয় প্রচার-প্রচারণা, লোকসমাগম ঘটানো, এবং বঙ্গবন্ধুকন্যার নিরাপত্তার ব্যবস্হা ইত্যাদি ।

ডা. হারিছ আলীর নেতৃত্বে নবগঠিত যুক্তরাজ্য যুবলীগ তাদের ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব দক্ষতা এবং নিষ্ঠার সাথে পালন করে। অবশেষে ১৯৮০ সালের ১৬ আগস্ট ইয়র্ক হলের সেই ঐতিহাসিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন প্রবাসী বাঙালিদের ঢল নামে ইয়র্ক হলে। পরদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অভিষেক মিটিং সম্বন্ধে মূলধারার বৃটিশ সংবাদপত্রগুলোতে শিরোনাম হয় ‘A new political star is born’. 

১৯৮১ সালের ২ ডিসেম্বর  ডা. হারিছ আলী স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। জন্মভূমি ছাতক এবং বৃহত্তর সুনামগঞ্জে আওয়ামীলীগকে সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী করতে নিজেকে সঁপে দেন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ছয় বছরের মধ্যে ছাতকে আওয়ামীলীগের অবস্থা এমন নাজুক হয়েছিল যে বিভিন্ন স্তরে এদলটির কোন কমিটি ছিল না বললেই চলে। মূল সংগঠন আওয়ামীলীগ কোনমতে টিকে ছিল পরাণও ধরিয়া! মাত্র দু’চারজন নিবেদিতপ্রাণ নেতা আঁকড়ে ধরে ছিলেন। ছাতক শহর, কলেজগুলোর কোথাও ছাত্রলীগের কমিটি ছিল না। ‘৮১ সালে হারিছ আলী দেশে ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই ছাতকের রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করে।

আওয়ামীলীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের সদস্য সংখ্যা বাড়তে আরম্ভ করে। সবখানে সকল স্তরে কমিটি গঠন করা হয়। ডা. হারিছের নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে ছাতক ডিগ্রি কলেজে শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়। একইভাবে গোবিন্দগঞ্জ কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি করা হয়। এসমস্ত কর্মকান্ডের  নেপথ্যে এবং প্রকাশ্যে মূল ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুপ্রেমী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দেশপ্রেমের আদর্শে উজ্জ্বীবিত জননেতা ডা. হারিছ আলী। 

ডা. হারিছ আলী ১৯৯৩ – ২০১৩ পর্যন্ত দীর্ঘ দুই দশক ধরে অর্থাৎ ২০১৩ সালের ২০ আগস্টে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে ছাতক উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া, নয়ের দশকে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতির দাযিত্ব পালন করেন। তিনি চাইলেই সিলেট জেলা/মহানগরে বা ঢাকা শহরে রাজনীতি করে সহজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতেন। কিন্ত্ত ডা. হারিছ আলী কখনও নিজেকে ‘প্রতিষ্ঠিত’ করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন, শুধু জন্মভূমি ছাতক-দোয়ারার মানুষের সেবা করতে। 

মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ

ডা. হারিছ আলী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্যে ২৫ মার্চের বেশ আগে থেকেই প্রস্ত্তত ছিলেন। ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে তিনি যুদ্ধযাত্রার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্ত্ততি নিতে শুরু করেন। তাই ২৫ মার্চ পাক হানাদারদের আক্রমণ শুরু হলে ডা. হারিছ কালক্ষেপণ না করে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহেই ভারত সীমান্তের বাঁশতলা-চেলায় চলে যান। ইতিমধ্যে সেখানে ক্যাম্প নির্মাণও শুরু হয়ে গেছে। 

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ডা. হারিছ আলী বহুমুখী ভূমিকা পালন করেন। প্রথমত, চিকিৎসক হলেও তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি একজন রাজনীতিবিদ। তাই মুক্তিযুদ্ধে তাঁর প্রধান ভূমিকা ছিলো রাজনৈতিক সংগঠকের। তিনি তরুণ-যুবকদের যুদ্ধে যোগ দিতে অনুপ্রাণিত করেন, সাহস জোগান। দেশের ভেতরে অবস্হানরত তরুণদের বিশেষ করে কলেজ ছাত্রদের কাছে ‘চরের’ মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে তাদের সীমান্তে আসার আমন্ত্রণ জানান। তারা সেখানে এলে পর তাদের ভারতের মেঘালয় রাজ্যে অবস্থিত ইকো-ওয়ান ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্যে পাঠাতেন।

মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহেও ডা. হারিছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

অন্যদিকে, ডা. হারিছ আলী একজন চিকিৎসক। তাই যোদ্ধাহত, অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। ভোলাগঞ্জে রূপওয়ের বাঙ্কারে বিশ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রবাসী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে ৫ নং সেক্টরের চেলা ও ভোলাগঞ্জ, এই দুটো সাব-সেক্টরের  রেজিমেন্টাল মেডিক্যাল অফিসার নিয়োগ করে। 

তদুপরি, ডা. হারিছ যুদ্ধ চলাকালে গোয়েন্দা শাখার কাজও দেখাশোনা করতেন। তিনি পাক হানাদারদের তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশের অভ্যন্তরে ‘চর’ পাঠাতেন। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতেন। চিকিৎসক হলেও বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা আর আপন কৌতূহলে তিনি গোয়েন্দা কাজ তদারকিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেছিলেন। এক্ষেত্রে ডা. হারিছের মূল কৌশলটা ছিল, রাজাকার বাহিনিতে নিজেদের লোক অনুপ্রবেশ করানো, তারপর তাদের সহায়তায় রাজাকারদের “পরিচয়পত্র” সংগ্রহ করা। অত:পর মুক্তিযোদ্ধাদের কারও হাতে সেই “পরিচয়পত্র” দিয়ে তাকে হানাদার বাহিনির তথ্য সংগ্রহের কাজে পাঠানো। পাকপাক বাহিনির হাতে ধরা পড়লে সে তার ‘রাজাকার পরিচয়পত্র’ দেখিয়ে প্রাণে রক্ষা পেত।

শিক্ষা বিস্তারে ডা. হারিছ আলী

ডা. হারিছ আলী আজীবন শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে গেছেন। এর বিস্তারে নিরন্তর আন্তরিকভাবে কাজ করেছেন। এমনকি ব্যক্তিগত সার্কেলেও সেই চেষ্টা জারি রেখেছিলেন। দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরের মানুষের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল শিক্ষা। ডা. হারিছ তরুণদের সব সময় সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিতেন। বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলের পশ্চাৎপদ মানুষকে কীভাবে শিক্ষিত করা যায়, এ নিয়ে সর্বদা তিনি শুধু ভাবেননি, কাজ করেছেন, সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

ডা. হারিছ আলী জীবদ্দশায় বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পত্তন, উন্নয়ন এবং বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৯৫ সালে জাউয়া বাজার ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর যুগান্তকারী অবদান এলাকার কৃতজ্ঞ মানুষ চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে এ কলেজটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। এবং বিভিন্ন স্তরে সরকারী অনুমোদনপ্রাপ্তি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সহায়তায় এমপিওভুক্তিকরণ থেকে শুরু করে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে তহবিল সংগ্রহ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন। সম্মুখে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। সেজন্যে এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবেসে কলেজের একটি ভবন ‘ডা. হারিছ আলী স্মৃতি ভবন’ নামকরণ করেছে। 

গত শতকের আশির দশকে সিলেট শহরস্থ দি এইডেড হাইস্কুৃলের অবকাঠামো উন্নয়নে ডা. হারিছ আলী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তখন তিনি ছিলেন স্কুলটির পরিচালনা পরিষদের সদস্য। সে সময়ে একটি দোতলা একাডেমিক ভবন নির্মাণের জন্য তাঁর লন্ডন প্রবাসী বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে দেন। সেই সময় এইডেড হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ তজম্মুল আলী। 

ছাতক থানার দ্বিতীয় কলেজ গোবিন্দগঞ্জ আবদুল হক স্মৃতি কলেজের উন্নয়নেও ডা. হারিছ আলী অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৬/৭৭ সালে লন্ডন প্রবাসী ছাতকের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কলেজের উন্নয়নের জন্যে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেন। সেই সময় ডা. হারিছ আলী উচ্চশিক্ষার্থে বিলাতে অবস্থান করছিলেন। কলেজটির উন্নয়ন তহবিল সংগ্রহের কাজ চলছে জেনে তিনিও ছুটে যান। এ উদ্দেশ্যে আয়োজিত সভা-সমাবেশে উপস্থিত থেকে এলাকার প্রবাসীদের অর্থদানে উদ্বুদ্ধ করেন। এবং তহবিল সংগ্রহে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।   

সাংবাদিক জীবন

১৯৭৬-‘৮১ বিলাতে থাকাকালীন ডা. হারিছ আলী সাংবাদিকতা করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অমর একুশে গানের গীতিকার আবদুল গাফফার চৌধুরী সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বাংলার ডাকের’ সহকারী সম্পাদক হিশেবে যোগ দেন। ১৯৮১ সালের ডিসেম্বরে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের আগ পর্যন্ত এ কাগজে কাজ করেন। শুধু সম্পাদনা নয়, সেখানে নিয়মিত লেখালেখিও করেন।

১৯৮০ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানার তত্ত্বাবধানে লন্ডন থেকে সাপ্তাহিক ‘বজ্রকণ্ঠ’ প্রকাশিত হয়। প্রধান সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক ‘ভাসানী যখন ইউরোপে’ গ্রন্থের লেখক আবদুল মতিন। ডা. হারিছ ‘বজ্রকণ্ঠের’ সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য ছিলেন।

শিল্প-সাহিত-সংস্কৃতিতে ডা. হারিছ আলী 

ডা. হারিছ আলী ছিলেন কবি মনের অধিকারী এবং  সুস্থ ও পরিচ্ছন্ন ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী আলোকিত ব্যক্তিত্ব। আন্তর্জাতিক মনষ্ক একজন মানুষ। কৈশোর থেকে তিনি শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। বই পড়ার প্রতি ছিল তাঁর তীক্ষ্ণ আগ্রহ। বিচিত্র সব বিষয়ের বইপত্র পড়তেন। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির প্রতি উৎসাহী হয়ে ওঠেন।

তিনি অসংখ্য ছড়া, লিমেরিক, কবিতা, গান, প্রবন্ধ, লিখেন। আজীবন লিখে গেছেন। নিজের কাজ সংরক্ষণ বা জাহির করার মনমানসিকতা তাঁর কখনও ছিল না। সেজন্যে অধিকাংশ লেখা হারিয়ে গেছে।

তারপরও ২০০৭ সালে তাঁর লেখা লিমেরিক এবং গানের একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশ করেছে ঢাকার উৎস প্রকাশনী। তাঁর মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন সূত্র থেকে আরও কিছু লেখা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছেন। আশা করা যায়, ডা. হারিছের লেখা এসব ছড়া, কবিতা, গান, প্রবন্ধ ইত্যাদি নিয়ে আরও দু’একটি গ্রন্থ প্রকাশ করা সম্ভব হবে। 

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ডা. হারিছ অসংখ্য ছড়া, কবিতা, গান লিখছেন। তন্মধ্যে একটি গান বিলেতের আওয়ামী মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। গানটি হলো ‘ও রে সুরমা নদীর নাইয়া/আমার খবর কইও তুমি টুঙ্গী পাড়ায় যাইয়া’। আশা করা যায়, গানটি একদিন সারা দেশে জনপ্রিয়তা লাভ করবে।