ডা. হারিছ আলীর কাঙ্ক্ষিত আলাপ


আবদুস সহিদ মুহিত

ডা. হারিছ আলী ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার একজন নিবেদিতপ্রাণ পুরুষ। ছিলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা। পেশায় চিকিৎসক হলেও আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ ছিলেন। দেশের স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত ও এর জঙ্গি ছাত্রসংগঠন শিবিরকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন। দলের শীর্ষ নেতা বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাসহ সকল শ্রেণির নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর।
আমি সবেমাত্র এইচএসসি পাস করেছি। আমার ছোট বোনের বিয়েতে ডা. হারিছ আলী উপস্থিত হলেন আমাদের গ্রামের বাড়িতে (গোয়াশপুর)। তিনি বাবার বন্ধু ছিলেন, সেই সুবাদে বিয়ের দাওয়াত দিতে গিয়ে সেদিনই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। পরবর্তীকালে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিশেষ করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্বে মিছিল মিটিংয়ে নিয়মিত অংশ নিয়েছি। তিনি একজন ভালো বক্তা ছিলেন। স্পষ্ট কথা বলতেন, সত্য কথা বলতেন। দলীয় সভায়ও স্পষ্ট কথা বলতেন, কেউ অনৈতিক কথা বললে ধমক দিতেন। লুটেরা আর টাউট প্রকৃতির লোকদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ছিল অগাধ শ্রদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও বাহক ছিলেন। আজকাল জননেতা হতে হলে সব শ্রেণির লোককে কাছে স্থান দেওয়ার একটা প্রতিযোগিতা চলে। ডা. হারিছ আলী ছিলেন এর ব্যতিক্রম। ফলে একটা শ্রেণির লোকজন তাঁকে পছন্দ করত না।
নিয়মিত চেম্বারে বসতেন, রোগী দেখতেন। বেশিরভাগ সময় রাজনৈতিক আলাপই করতেন। অনেকের কাছ থেকেই ভিজিট নিতেন না।

লন্ডনে যখন থাকতেন তখন শেখ হাসিনাও সেখানে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। নেত্রীর সঙ্গে হারিছ আলীর যে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তা গত বছর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে দেখেছি সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের কর্মীসভায় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাই বলেছেন ডা. হারিছ আলী সম্পর্কে।

আমরা ওই কথাগুলো মনে করিয়ে দিলে তিনি তখন নস্টালজিয়ায় চলে যেতেন। আবেগে আপ্লুত হয়ে যেতেন, মনে পড়ে যেত লন্ডনের সেই স্মৃতিগুলো। আমাদের বলতেন, স্মৃতির পাতা থেকে নানা কথা।
আমার সঙ্গে প্রায় সময়ই দেখা হত তাঁর। দেখা হলেই আমার প্রয়াত বাবার (হাজি আলতাব আলী) কথা বলতেন। লন্ডন যখন থাকতেন, আমার বাবাও তখন সেখানে ছিলেন। তিনিও একজন আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি অগাধ আস্থা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবাসী সরকারকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতেন। প্রচন্ড দেশপ্রেম ছিল। সপ্তাহের বেতন পাওয়া মাত্র প্রবাসী সরকারের ফান্ডে টাকা প্রেরণ করতেন।
ডা. হারিছ আলীকে রাজনীতিতে অনেকেই ব্যবহার করেছেন। তিনি বোঝেও না বোঝার ভান করতেন। রাজনীতি এখন টাকার কাছে বন্দি। আদর্শ বলতে তেমন কিছুই আর খুঁজে পাওয়া যায় নাÑতা উপলব্ধি করতেন।

ডা. হারিছ আলীর সঙ্গে আমার সর্বশেষ কথা হয় তিনি মারা যাবার ক’দিন পূর্বে। তখন ছিল কোরবানির ঈদ। শহর কিছুটা ফাঁকা। স্টেডিয়াম-পাড়া তখনও জমে ওঠেনি। অন্যদিকে জামায়াত-শিবির যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে আন্দোলন করছে, নাশকতা চালাচ্ছে। তাই লোকজন তেমন একটা নেই। ঈদের পরের দিন বিকাল ৫টায় আমাকে মোবাইলে কল দিলেন। বললেন, তুমি কোথায় আছ, আমার সঙ্গে আগামীকাল বিকেলে দেখা করো, আলাপ আছে। আমি সবিনয়ে ‘লিডার আসবো’ বলে কল রেখে দিলাম।
রাতে একবার মনে হল লিডার আমার সঙ্গে কী নিয়ে আলাপ করতে চান। হয়ত ছাতকের রাজনীতি সম্পর্কে কিছু বলতে চান। ছাতকে আওয়ামী লীগ খুবই শক্তিশালী ছিল। স্বাধীনতার পূর্ব থেকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর জননেতা মোহাম্মদ আবদুল হকের মৃত্যুর পর জননেতা আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন এ অঞ্চলের নেতা। ১৯৭৩ সালে সামাদ সাহেব আসনটি ছেড়ে দিলে আওয়ামী লীগের মধ্যে কোন্দল শুরু হয়। তখন থেকেই অপরিচিত প্রার্থী বা প্রার্থীর বিরোধিতা যেন একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এখনও আওয়ামী লীগের কর্মীসভা বা রাজনৈতিক চর্চার কোনও তৎপরতা দেখা যায় না। ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিন জাতীয় শোক দিবস পালিত হয় না। ২১ অগাস্ট শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে কোনও কর্মসূচি পালিত হয় না। আমরা অবাক হই, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানীর মূল কেন্দ্রে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়া কেমন করে এই ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হয়। বর্তমানে বহুধা বিভক্ত দলে কেউ আছেন সংবর্ধনার নামে চাঁদাবাজি আর আত্মীয়করণ, আর কেউ আছেন টাকা বানাতে ব্যস্ত। এ সব ভাবনা-সম্বলিত লিডারের ‘আলাপ আছে’ নিয়ে একটু চিন্তা করি। আমাকে তিনি খুবই স্নেহ করতেন। প্রথমত আমার বাবার কারণে, দ্বিতীয়ত তিনি জানতেন আমি মাস্টার্স ডিগ্রি পাস করেছি। বিদেশে যাইনি বা চাকরি করিনি। রাজনীতির সঙ্গে আছি। থানা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছি। উপজেলা যুবলীগের নেতৃত্বে ছিলাম। এই সূত্রে তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। আমাকে বলেছিলেন, ‘তোমাকে নিয়ে একদিন নেত্রীর কাছে যাব।’
যাক, যথারীতি পরের দিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল স্টেডিয়ামের কাছেই; রিকাবিবাজার মসজিদ থেকে আছরের নামাজ পড়ে তিনি বের হলেন, আমিও। দেখা হতেই আমার হাত ধরে তাঁর চেম্বারের দিকে রওয়ানা হলেন। অডিটোরিয়ামের গেটে পূর্ব থেকেই আমার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন সাবেক দুই ছাত্রলীগ নেতাÑঅ্যাডভোকেট মাসুম আহমদ ও অ্যাডভোকেট জয়ন্ত ধর। তাদের কাছে যেতেই সেখানে ডা. হারিছ আলী ৫ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে ছাতকের রাজনীতির বেহাল অবস্থা নিয়ে কথা বললেন। আমাদেরকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার কথা বললেন। কথার এক পর্যায়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করাই তোমার রাজনীতির জন্য কাল। বর্তমানে যারা আছে কেউ তোমাকে মানতে চাইবে না, তাদের ঈর্ষার কারণ তোমার শিক্ষা।’ এ কথাগুলো বলেই তিনি ‘আজ আর সময় নেই, পারিবারিক ব্যস্ততা আছে’ বলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন এবং তার আগে বললেন, ‘আগামীকাল তুমি এসো।’ আমরাও সালাম জানিয়ে বিদায় নিলাম। পরের দিন জামায়াত-শিবির দুই দিনের হরতালের ডাক দিয়েছে। সেজন্য তিনি চেম্বারে আসতে পারেননি। আমি যথারীতি চেম্বারে গেলাম, চেম্বার বন্ধ। খবর পেলাম ডা. হারিছ আলী স্ট্রোক করেছেন, অতঃপর মৃত্যু। আমি নির্বাক। সকলেই নির্বাক।

ডা. হারিছ আলী চলে গেলেন ইহজগৎ ছেড়ে না-ফেরার দেশে। আমার সঙ্গে তাঁর না-বলা ‘আলাপ’ রয়েই গেল। আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় সেই না-বলা ‘আলাপ’। আক্ষেপ রয়েই গেল আমার, আক্ষেপ রয়েই গেল নেত্রীর সঙ্গে আমাকে নিয়ে দেখা করার।

ডা. হারিছ আলী একজন ত্যাগী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ছিলেন। মাঠ পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের তিনি ব্যাপক অনুপ্রেরণা দিতেন। দেশের স্বার্থকে তিনি সবসময় বড় করে দেখেছেন। আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করি।

লেখক : সমাজকর্মী