জননেতার মৃত্যু এবং কিছু স্মৃতি

আলিমউদ্দিন আহমদ

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি ঐতিহ্যবাহী শিল্পনগরী ছাতকে অনেক জ্ঞানী, গুণী, রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাধক জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁদের অন্যতম ডা. হারিছ আলী। ২০১৩ সালের ২০ অগাস্ট রাত ১১টা ৩৩ মিনিটে অসংখ্য গুণগ্রাহী ও আত্মীয়স্বজন রেখে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে দেশে-বিদেশে বাঙালি কমিউনিটিতে শোকের ছায়া নেমে আসে। একজন মহান মানুষকে আমরা চিরদিনের জন্য হারিয়েছি। তাঁর এ চিরবিদায় আমাদের মাঝে যে শূন্যতা সৃষ্টি করেছে তা সহজে পূরণ হবার নয়।
হারিছ আলী শুধু একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক এবং গীতিকার। অন্যদিকে তাঁর আরেক পরিচয় হল তিনি ছিলেন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন সংগঠক। তিনি দীর্ঘ দিন ছাতক থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালীন মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। একজন সংগ্রামী ও নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিবিদ হিসেবে সকল মহলের কাছে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধেয়। জনাব হারিছ আলী ছিলেন একজন সুবক্তা। কথা দিয়ে বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে উজ্জীবিত করার, অনুপ্রাণিত করার এক বিশেষ গুণ ছিল তাঁর মধ্যে। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় দেশে গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রতিটি মুহূর্তে সোচ্চার ছিলেন। তিনি ১৯৭৯ সালে যুক্তরাজ্য যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর হাতে গড়া সংগঠন যুক্তরাজ্য যুবলীগ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাংলার শোষিত, নির্যাতিত, অসহায়, বঞ্চিত, গরিব, দুঃখী, মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে, সর্বোপরি ২০০৮ সালের সেনা সমর্থিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারের বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক অপকর্মের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য তারা অদ্যাবধি অতন্দ্র প্রহরীর মতো দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, শতাব্দীর মহানায়ক, স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহŸানে ডা. হারিছ আলী ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ডাক্তার হিসেবে রণাঙ্গনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দান করেন। এছাড়া একজন রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ছাতক-দোয়ারা-কোম্পানিগঞ্জ অঞ্চলে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০০১ সালে নীল-নক্শার নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিএনপি তথা চার দলীয় জোট রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। তারপর তারা দেশজুড়ে চালায় একের পর এক বোমা ফাটিয়ে হত্যা, নির্যাতন, খুন, রাহাজানি। এমনকী তারা আজকের সিরিয়া ও আফগানিস্তানের মতো জঙ্গি ও সন্ত্রাসী অপকর্ম দিয়ে বাংলার পবিত্র মাটিকে কলুষিত করতে চেয়েছিল। চারদলীয় জোটের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ছাতকের সর্বশ্রেণির সংগ্রামী জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তিনি দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

ডা. হারিছ আলী ছিলেন একজন নির্ভীক পুরুষ। তাঁর সাহসিকতার বিভিন্ন ঘটনা, নমুনা দেশে-বিদেশে জনে জনে ছড়িয়ে আছে। আমরা অনেকেই সেসব ঘটনা হয় প্রত্যক্ষ করেছি বা প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে জেনেছি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা হয়েছিল এ রকম একটি সাহসিকতার ঘটনা প্রত্যক্ষ করার। ১৯৯৫ সালে আমি গোবিন্দগঞ্জ আবদুল হক স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলাম। ছাত্রাবস্থায়ই আমি ছিলাম বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্রলীগের একজন কর্মী। সে বছর একদিন দেখলাম, ছাত্রদলের একটি মিছিল কলেজ থেকে বের হয়ে গোবিন্দগঞ্জ রেলগেইট সংলগ্ন নতুনবাজার প্রদক্ষিণ করে আবার রেলগেইটে এসে শেষ হয়। ঠিক সেই মুহূর্তে তৎকালীন কলেজ ছাত্রলীগের দুর্দান্ত সাহসী ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে আরেকটি মিছিল কলেজ ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে রেলগেইটের দিকে যায়। কিন্তু ছাত্রলীগের মিছিলটি রেলগেইট পয়েন্টে পৌঁছামাত্রই বিএনপির এক স্থানীয় ‘তথাকথিত প্রভাবশালী’র রোষানলে পড়ে। সেই নেতা ছাত্রলীগ নেতাদের উদ্দেশ্য করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন। ছাত্রলীগ নেতারা এরকম ‘নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব’ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে। ঘটনার এক পর্যায়ে ডা. হারিছ আলীর কানে সেই সংবাদ পৌঁছে যায়। গোবিন্দগঞ্জ তৎকালীন কেয়ার (জননী) ফার্মেসিতে তখন তাঁর চেম্বার ছিল। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ফার্মেসি থেকে বেরিয়ে এসে ‘জনৈক প্রভাবশালী নেতাকে’ উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ছাত্রদলের ছেলেরা মিছিল করলে অসুবিধা হয় না, আর আমার ছাত্রলীগের কর্মীরা শান্তিপ্রিয় মিছিল করলে অসুবিধা হয়Ñএটা কেমন কথা? রাজপথে সবার সমান অধিকার। ছাত্রলীগ রাজপথে মিছিল-মিটিং করবে। কারও সাহস থাকলে তা প্রতিহত করুক। আমি ডা. হারিছ আলী বলছি।’ তাঁর এ হুংকার শুনে ‘তথাকথিত প্রভাবশালী নেতা’ খামোশ হয়ে যান। কোনও শব্দ না করে তিনি চুপচাপ ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। ছাত্রলীগের ছেলেরা নির্বিঘেœ, নির্ভয়ে মিছিল-মিটিং শেষ করে ঘরে ফেরে।

১৯৭৫ পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ চতুর্দিক থেকে খুনি মোশতাক-চক্র এবং জিয়ার কাঁধে ভর করা স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি কর্তৃক কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সেই দুঃসময়ে বিলাতপ্রবাসী ডা. হারিছ আলী নিজের স্বজন-পেশা-পরিবারের স্বার্থ উপেক্ষা করে দিনরাত পরিশ্রম করেন আওয়ামী লীগ সংগঠনে, আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করণে। বিলাতজীবনেও তাঁর অনেক সাহসের ঘটনা রয়েছে। এরকম একটি ঘটনা শুনেছি বিশিষ্ট লেখক, কলামনিস্ট, সাংবাদিক, অমর একুশে গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীসহ অনেকের মুখ থেকে। জননেত্রী শেখ হাসিনা তখন বিলাতপ্রবাসী। আওয়ামী লীগের ‘হাল’ ধরার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন। সেই সময় পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেনস্থ ‘নাজ’ সিনেমা হলে একটি বিরাট সভার আয়োজন করা হয়। শেখ হাসিনা বক্তব্য দেওয়ার পর সভা শেষে যখন বেরিয়ে আসছিলেন তখন হলের সামনে বিএনপির কতিপয় গুন্ডা ‘প্রতিবাদের অভিপ্রায়’ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। জননেত্রীর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে আওয়ামী লীগের এক নেতা নেত্রীকে পেছনের দরজা দিয়ে বের হবার পরামর্শ দিলেন। ডা. হারিছ আলী তখন দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘আমরা যুবলীগ কর্মীরা প্রয়োজন হয় জান দেব, তবু নেত্রীকে নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে বের হব।’ তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে যুবলীগ নেতাকর্মীরা সেদিন বীরদর্পে নেত্রীকে নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে বের হলেন। এ দুটো ঘটনা থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন প্রতিবাদী চরিত্রের মানুষ। আর এই প্রতিবাদী, বিদ্রোহী চরিত্র এবং তাঁর ‘কিংবদন্তিতুল্য সততার’ কারণেই ডা. হারিছ আলীর প্রতি নেত্রীর ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা ও প্রচÐ আস্থা। নেত্রীর সঙ্গে ছিল তাঁর ভাই-বোনের সম্পর্ক। নেত্রীকে তিনি সবসময় আপা বলে সম্বোধন করতেন। জনাব হারিছ আলীর সুখে-দুঃখে নেত্রী সর্বদা খোঁজখরব নিতেন। নেত্রীর সঙ্গে তাঁর আন্তরিকতা কতটা গভীর ছিল তা আমাদের অনেকের জন্য উপলব্ধি করাও কঠিন। একমাত্র যারা তা স্বচক্ষে দেখেছেন তারাই সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন। ডাক্তার সাহেবের প্রতি নেত্রীর আন্তরিকতা স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল ১৯৯৬ সালের মে মাসে। সেই সময় জাতীয় নির্বাচনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে নেত্রী সিলেট সফর করেন। সেদিন আমি সিলেট শহরে ছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন ছাতক থানা ছাত্রলীগের এ টি এম কয়েস ভাই। আমরা দু-জন সিদ্ধান্ত নিই নেত্রীকে দেখার জন্য সার্কিট হাউসে যাওয়ার। সার্কিট হাউসে গিয়ে দেখি নেত্রী উপস্থিত দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করছেন। এক পর্যায়ে নেত্রী জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক ইফতেখার হোসেন শামীমকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ছাতকের ডাক্তার সাহেব’কে দেখছি না, তিনি কোথায়? আমি যখনই সিলেট আসি তিনি এক মুহূর্তের জন্য হলেও আমার সঙ্গে দেখা করেন। আজ তাঁকে দেখছি না যে?’ শামীম নেত্রীকে বললেন, ‘উনার স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন। তাই তিনি আসতে পারেননি।’ নেত্রী এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মিটিং শেষ করে দিলেন। বললেন, ‘চলো ডাক্তার সাহেবের বাসায় যাব।’ নেত্রী ছুটে গেলেন ডাক্তার সাহেবের তখনকার মজুমদারিস্থ বাসায়। সান্ত¡না দিলেন ডাক্তার সাহেবকে। আমিও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। নেত্রী ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি জীবনে তো কিছুই পেলেন না। আপনার কি কোনও কিছু চাওয়ার আছে?’ উত্তরে ডাক্তার সাহেব নির্দ্বিধায় বললেন, ‘আমি জীবনে অনেক কিছুই পেয়েছি। কিন্তু যে না পাওয়ার বেদনা বুকের মধ্যে প্রায়ই কষ্ট দেয়, যে স্বপ্নগুলো লালন করে আজও বেঁচে আছি সেগুলো হল : বঙ্গবন্ধুসহ যাঁরা সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন তাঁদের হত্যাকারী; বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার।

এই দৃশ্য আমি কোনও দিন ভুলবো না। নেত্রী সেদিন অশ্রæভেজা কণ্ঠে ডাক্তার সাহেবকে প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন, ‘ইনশাআল্লাহ এই সকল বিচারের কার্যক্রম একদিন বাংলার মাটিতেই সম্পন্ন হবে।’ নেত্রীর সেই প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু-হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধী ও বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারের কার্যক্রম অতি দ্রæততার সঙ্গে এগিয়ে চলছে। আমরা আশা করি, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বাংলার নির্যাতিত জনগণ এইসব কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী ও খুনিদের শাস্তি বিধানের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটকে ও পরবর্তীকালে ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগকে যে মহা আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে ভোট দিয়েছিল এর প্রতিফলন ঘটবে। স্বজন হারানো মানুষের হাহাকার ৪২ বছর ধরে বাংলার আকাশ-বাতাসকে প্রকম্পিত করছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের আনাচেকানাচে বাঙালি জাতি ১৯৭১-এর মতো আবার জেগে উঠছে। এবার এই খুনিরা নিস্তার পাবে না। তাদের বিচার সম্পন্ন করে আমরা বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করবই।

ডা. হারিছ আলী মনেপ্রাণে ছিলেন ছাতক-প্রেমিক একজন পুরুষ। ছাতকের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট যে কোনও বিষয়ে তিনি ছিলেন আপোশহীন। ১৯৯২ সালে ছাতকের সর্বস্তরের মানুষের প্রাণের দাবি ‘ছাতককে সিলেটের সঙ্গে সংযুক্ত করণের’ জন্য ছাতকের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে যে প্রস্তাব উত্থাপিত হয় তাঁদের মধ্যে ডা. হারিছ ছিলেন অন্যতম। আজ যে মুহূর্তে ছাতকের রাজনৈতিক অঙ্গনের উজ্জ্বল ধ্রæবতারা, বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী একজন কৃতীসন্তানের জীবনের বিভিন্ন কর্মকাÐ ও অবদান সম্পর্কে লিখছি, ঠিক সেই মুহূর্তে বৃহত্তর সুনামগঞ্জের আরও অনেকের মুখ, অনেক স্মৃতি চোখের পরদায় ভেসে উঠছে। এই ক্ষণজন্মা পুরুষরা তাঁদের শ্রম দিয়ে, মেধা দিয়ে, বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা স্বীকার করে সুনামগঞ্জ তথা দেশবাসীর বিভিন্ন দাবি ও অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা দেশ ও জাতিকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করেছেন, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁরা আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তু আমাদের চিন্তা-কর্মে, আমাদের হৃদয়ের মণিকোঠায় তাঁদের স্মৃতি চির জাগরূক। এসব ত্যাগী সমাজহিতৈষী ব্যক্তির নাম আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তাঁরা হলেন, (মরহুম) জননেতা আলহাজ আবদুস সামাদ আজাদ, কমরেড প্রসূন কান্তি (বরুণ রায়), এম এ হক, অ্যাডভোকেট আবদুজ জহুর, হেমেন্দ্র দাশ পুরকায়স্থ (হেমবাবু), সমছু মিয়া চৌধুরী, আকমল আলী মোক্তার, এম এ সালাম প্রমুখ।

ডাক্তার সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৯২ সালে। অদ্ভুত একটা বিষষ হল তাঁর সঙ্গে আমার ছাতক বা সিলেটে দেখা হয়নি, প্রথম দেখা হয় ঢাকায় আমার শ্রদ্ধেয় চাচা প্রখ্যাত সাংবাদিক এম বশির আহমদের আজিমপুরস্থ বাসভবনে। আমার চাচা এবং ডাক্তার সাহেব ছিলেন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। খুব হৃদ্যতা ছিল দু-জনের মধ্যে। ডাক্তার সাহেবকে ছাতকের রাজনীতিতে সহযোগিতা করার জন্য চাচাই আমাকে পরামর্শ দেন। তখন থেকেই ডাক্তার সাহেব আমাকে ভাতিজার মতো স্নেহ করতেন। আর একই রাজনৈতিক পরিবারে সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে, নেতা হিসেবে তিনি আমাকে সব সময় বুদ্ধি, পরামর্শ, উপদেশ দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন।

ডাক্তার সাহেব সর্বশেষ যুক্তরাজ্য সফর করেন ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ থেকে ৫ জুন পর্যন্ত। সেই সময় একদিন আমার বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ ছেলে ফেরদৌস কবির টিপু। সেদিন দীর্ঘক্ষণ ছাতক তথা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে বিশদ আলাপ-আলোচনা করেন। আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি ছাতককে নিয়ে তাঁর স্বপ্নের কথা বলেন। তিনি স্মৃতিচারণ করেন কীভাবে তরুণ বয়সে ডাক্তারি ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর সরকারি চাকরি ছেড়ে ষাটের দশকে ছাতকের মানুষের চিকিৎসা সেবার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন। একইভাবে ১৯৮২ সালে যুক্তরাজ্য থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে তিনি শুধু সিলেটে বসে থাকেননি। আবারও প্রাণের টানে ছুটে গিয়েছেন ছাতকের মানুষের দোরগোড়ায়। ছাতকবাজার, গোবিন্দগঞ্জ পয়েন্ট, ধারনবাজার, জাউয়াবাজার, এমনকী দোয়ারাতেও চেম্বার খুলে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেন। তাঁর বিনা পয়সার চিকিৎসা সেবার কাহিনি আজ কিংবদন্তির মতো ছাতক তথা সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে মানুষের মুখে মুখে। সেদিন তিনি আমার বাসায় বসে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, আগামী দিনে ছাতক একটি সুখি, সুন্দর, সমৃদ্ধ, আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক ও সন্ত্রাসমুক্ত জনপদ হিসেবে দেশজুড়ে পরিচিতি লাভ করবে। তাঁর হাতে গড়া ছাতকের তরুণ নেতৃত্ব নিয়েও তাঁকে প্রত্যয়ী মনে হয়েছিল।

তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব তাঁরা দেশ-জাতি-মানুষের কল্যাণে সঠিকভাবে পালন করবে। সত্যিকার অর্থে সাবেক ছাত্রনেতাদের তিনি আন্তরিকভাবে ভালোবাসতেন, ডাক্তার সাহবকে নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই।

আমাদের সকলের জন্য, সিলেটবাসীর জন্য, বিশেষ করে ছাতকবাসীর জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গৌরবের বিষয় হল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের বিশেষ স্বীকৃতিস্বরূপ প্রয়াত ডা. মোহাম্মদ হারিছ আলীকে ২০১৪ সালের স্বাধীনতা পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই প্রথম ছাতকের কোনও কৃতীসন্তান জাতীয় পদকের সম্মান লাভ করলেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এবং রণাঙ্গনে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবায় অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদক প্রদান করায় নিষ্ঠাবান ও সৎ রাজনীতির প্রবাদপুরুষ বলে সুপরিচিত ডা. মোহাম্মদ হারিছ আলীর বিলম্বে হলেও কিছুটা মূল্যায়ন হয়েছে। দুঃখজনক হল তাঁর জীবদ্দশায় আমরা কেউ-ই তাঁর উপযুক্ত মূল্যায়ন করিনি। তাঁকে তাঁর যথাযথ সম্মান দেখাতে আমরা সবাই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এ লজ্জা আমাদের সবার। তাঁর মূল্যায়নে কার্পণ্য করার ফলে দেশ-সমাজ-মানুষেরই ক্ষতি হয়েছে। যে জাতি তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উপযুক্ত মূল্যায়ন করে না, সেই জাতির প্রগতি ‘পথহারা, স্রোতহারা নদীর’ মতোই বদ্ধ হয়ে পড়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে সঠিক শিক্ষাগ্রহণ করতে পারলে আমরা ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি করব না।

পরিশেষে বলতে চাই জনাব হারিছ আলীর বাহাত্তর বছরের বর্ণাঢ্য জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নির্লোভ, নির্ভীক, নিরহংকারী ও বিনয়ী। শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা, গণতান্ত্রিক ম‚ল্যবোধের অনুসরণ, নিখাদ দেশপ্রেম এবং সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ববোধই ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উল্লেখযোগ্য দিক। তাঁর নীতি, নৈতিকতা, আদর্শ, দিঙ্নির্দেশনা, তাঁর জীবন-দর্শন হোক আমাদের আগামী দিনের পাথেয়। তাঁর চরিত্রের সৌরভ আলোকিত করুক ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে যুগে যুগে।

লেখক : সাবেক যুগ্মআহবায়ক, ছাতক উপজেলা আওয়ামী যুবলীগ