তাঁর কীর্তি অম্লান থাকবে


মো. সফিকুল ইসলাম

ডা. হারিছ আলী ছিলেন নেতৃস্থানীয় একজন সম্ভ্রান্ত মনের সরল মানুষ। জনদরদি চিকিৎসক ও সিনিয়র ত্যাগী রাজনীতিবিদ হিসেবে আমরা তাঁকে চিনতাম ছোটবেলা থেকে। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে মান্য করতাম বড় ভাইয়ের মতো। পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা নিরসনে তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতাম। তখন তিনি জাউয়াবাজারে নিয়মিতভাবে আসতেন। মোমিন ফার্মেসিতে রোগী দেখতেন। ধনী-গরিব সকল রোগীকে সমান গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থাপত্র দিতেন। কারও কাছে টাকা খুঁজতেন না। যে যা দিতেন তা-ই খুশি মনে গ্রহণ করতেন। তিনি ছিলেন সর্বদাই সেবাব্রতী। এলাকার উন্নয়নে সচেষ্ট ছিলেন আমৃত্যু। একবার তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
নির্বাচিত না-হয়েও জনগণের সেবা ও এলাকার উন্নয়ন করা যায়, এ-কথা তিনি বিশ্বাস করতেন। এ জন্য নীরবে তিনি তাঁর সাধ্যমতো মানুষের সেবা করে গেছেন, শিক্ষার উন্নয়নে পথিকৃতের অবদান রেখে গেছেন। জাউয়াবাজার ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা ও এর উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা স্মরণযোগ্য। মনে আছে তাঁর উদ্যোগে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ নিয়ে আমরা প্রথমবারের মতো একটি বৈঠকে মিলিত হই হাজি শানুর আলী মুনশির বাড়িতে। ওই বৈঠকে আশপাশের বহুগ্রাম থেকে নানা বয়েসি অনেক লোকজন জড়ো হয়েছিলেন। কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কমিটিও গঠিত হয়েছিল। কাইস্তকোনার ইদ্রিস আলী সভাপতি ও ডা. হারিছ আলী সাধারণ সম্পাদক পদে মনোনীত হয়েছিলেন। শানুর আলীর ভাতিজা মো. হাবিবুর রহমানও সেই বৈঠকে ছিলেন। ছিলেন জাউয়াবাজারের বিশিষ্ট মুরব্বি হাজি জুবেদ আলী, আতাউর রহমান, আস্তর মিয়া, চান মিয়া, হাজি হারুন মিয়া প্রমুখ। হাজি শানুর আলী মুনশির বাড়িতে তিন-তিনবার বৈঠক হয়। ইদ্রিস আলীকে কিছু দিন পর সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দিয়ে চেচান নিবাসী খলিলুর রহমানকে স্থলাভিষিক্ত করা হয়। কিন্তু ডা. হারিছ আলী ছিলেন কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা। তাঁর কথাবার্তা এবং বক্তব্য শুনে আমরা অদম্য সাহস পেতাম। তরুণেরাও শক্তি পেত। সকলের মিলিত সাহসে এবং অনুরোধে প্রথমে কলেজের জন্য একটি টিন-বাঁশের ঘর নির্মাণ করা হয় লক্ষণসোম গ্রামে হাজি আসাব আলীর জায়গাজমিতে। এ সময় ডা. হারিছ আলী এলাকাবাসীদের নিয়ে জাউয়াবাজারের দোকানে দোকানে চাঁদা সংগ্রহ করতেন। স্থানীয় তরুণ মিসবাহ-উজ-জামান সিলু, জয়নুল হক, এখলাসুর রহমান প্রমুখ বাঁশ-টিন সংগ্রহ কাজে আগ্রহী ভূমিকা পালন করেন। সুখের খবর হল, আজ সেই কলেজ বহুতল ভবনে প্রতিষ্ঠিতÑএকটি স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ। প্রায় ১৫০০ ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করছে, কুড়ি বাইশজন শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কর্মচারী রয়েছেন। কলেজটি অনেক আগেই এমপিও-ভুক্তি হয়েছে। এ-ক্ষেত্রেও ডা. হারিছ আলীর একক অবদান তাঁকে এলাকাবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। মনে আছে, তাঁর সঙ্গে আমি একাধিকবার ঢাকায় গিয়েছি। সে সময় ডাক্তার সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্র ফেরদৌস কবির টিপু চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ছুটে আসেন। এবং তাঁর যশোহরের বন্ধু হাবিবের বড় ভাই রেজাউল করিমকে সঙ্গে নিয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী এ এইচ কে সাদেকের গুলশানস্থ বাসায় যাই। তখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন কলেজের সভাপতি খলিলুর রহমানও। আমরা শিক্ষামন্ত্রীর হাতে এমপিও-ভুক্তির আবেদনপত্রটি দিই। এবং শিক্ষামন্ত্রী তাতে স্বাক্ষর করেন। এত কিছুর পরও যখন স্থানীয় কজন প্রভাবশালীর মদদে কলেজটির এমপিও-ভুক্তি হচ্ছিল না, তখন ডা. হারিছ আলী সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হয়ে এমপিও-ভুক্তি করেন। আজ দেখতে ভালো লাগছে, কলেজের একটি ভবন তাঁর নামে নামকরণ করে কিছুটা হলেও তাঁর অবদানের স্বীকৃতি বহন করছে।
ডা. হারিছ আলী ছিলেন একজন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তাঁকে যেমন আমরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মান করি, তিনিও অগ্রজের প্রতি ছিলেন উদার। শ্রদ্ধা ভক্তি প্রকাশ করতেন জননেতা মোহাম্মদ আবদুল হকের প্রতি। প্রায়ই বলতেন, ‘তিনি (আবদুল হক) ছিলেন আমাদের নেতা। আমরা তাঁকে মান্য করতাম। তিনিও ভীষণ স্নেহ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এম এ জি ওসমানী প্রায়ই হক সাহেবকে পত্র লিখে নির্দেশ দিতেন। তিনিও চিঠির জবাব লিখে আমাদের যৌথ স্বাক্ষর সম্বলিত চিঠি প্রেরণ করতেন।’ ডা. হারিছ আলীকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আবদুল হক এমনইভাবে মূল্যায়ন করতেন। এসব কথা হারিছ আলীর মুখ থেকে শুনে আমাদেরও তাঁর প্রতি একটা গোপন শ্রদ্ধা ভেতরে ভেতরে জন্ম নিত।
তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ এবং ধর্মভীরু। ধর্মের প্রতি অনুরাগ ছিল প্রবল। প্রায়ই মসজিদে যেতেনÑআজানের আগে। নীরব সেবক, কর্মবীর এই মানুষটি নীরবেই চলে গেলেন। পড়ে থাকল তাঁর উজ্জ্বল জীবনের কৃতি ও কীর্তি। যা তাঁর স্মৃতিকে অ¤øান করে রাখবে।

লেখক : জাউয়াবাজার ডিগ্রি কলেজের গভর্নিং বডির দাতা সদস্য