কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ ডা. হারিছ আলী

এ টি এম কয়েস

সেই ১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগ; অতঃপর ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাপূর্বক ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামে অধিকন্তু স্বাধীনতা-উত্তর দেশ পুনর্গঠন; ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর সেই ভয়াল দিনগুলো থেকে দেশের সব ক’টি গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে যে সকল বরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ইতিহাসে অমরতা লাভ করেছেনÑসুনামগঞ্জের মৃত্তিকায় জন্ম নেওয়া সমকালীন কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ ডা. হারিছ আলী তাঁদের একজন।

সত্যি বলতে কী আমার প্রিয়, শ্রদ্ধেয় নেতার ওপর লেখতে কলম যেন এগোয় না, কেবল শোকস্তব্ধতার ব্যাকুলতা। নাতিদীর্ঘ এ-লেখা কেবল নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাবার প্রয়াস মাত্র।
রাজনীতিবিদ ডা. হারিছ আলীর সঙ্গে আমার পরিচয় সেই ১৯৯০ সালে। তিনি তখন উপজেলা ইলেকশনে চেয়ারম্যান পদে মোটরগাড়ি মার্কা নিয়ে রীতিমতো ভোটযুদ্ধে। অধিকন্তু ছাতক থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। সেই থেকে আমি নেতার একজন অনুরক্ত। খুব মনে পড়ে ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলনে তাঁর সাহসী ও সোচ্চার ভূমিকার কথা। ১৯৯৬ সালে নেতার পরামর্শে আমরা কজন বন্ধুবান্ধব মিলে জালালপুরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পরিষদ প্রতিষ্ঠা করি। আমরা সেখানকার মহাসড়ক পয়েন্টে জনসভার আয়োজন করলে ডা. হারিছ আলী এতে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন। অতঃপর দক্ষিণ ছাতকভিত্তিক ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠা পূর্বক আমার সভাপতিত্বে পিরপুরবাজারে বিরাট জনসভা করি; এতেও শ্রদ্ধেয় নেতা সর্বাত্মক সহযোগিতা করে প্রধান অতিথি হিসেবে উদ্দীপনামূলক বক্তব্য রাখেন। এরপর এলো ১৯৯৬-এর সংসদ নির্বাচন। ঢাকায় সুধাসদনে জননেত্রী শেখ হাসিনা, গণতন্ত্রী পার্টি থেকে আগত মুহিবুর রহমান মানিককে দলীয় মনোনয়ন প্রদানের মুহূর্তে ডা. হারিছ আলীকে ছাতক-দোয়ারা আসনে বিজয়ের ভার অর্পণ করেন। নেত্রীর নির্দেশে ডা. হারিছ বলতে গেলে মুক্তিযুদ্ধের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রবল ঝড়-জলোচ্ছ¡াস, বন্যা-বর্ষণমুখর সেই নির্বাচনী ঝড়ো হাওয়ায় তিনি সিলেট শহর থেকে ছুটে এসে ছাতক-দোয়ারার প্রত্যন্ত গ্রাম-পাহাড় মাড়িয়েÑগণসংযোগে, পথসভায়, জনসভায় বক্তৃতা প্রদানে কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেন। আমি সেই নির্বাচনে নেতার সহচর রূপে অসংখ্য জনসভায় বক্তৃতা ও উপস্থাপনার দায়িত্বে ছিলাম। নির্বাচনে জননেত্রী শেখ হাসিনা গোবিন্দগঞ্জ এবং একই দিনে সুনামগঞ্জ থেকে ফিরে ছাতকে জনসভায় বক্তৃতা প্রদানের ফলে নৌকার পালে বিজয়ের বাতাস লেগেছিল। কিন্তু দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয়, বিজয়ের পর সাংসদ নেতার সুধাসদনে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতে ডা. হারিছ আলীকে মূল্যায়ন করতে দ্বিধা করলে তিনি হতবাক হয়ে পড়েন। অতঃপর ছাতকের রাজনীতিতে আগাছার বাড় বেশি হলেও মূল লীগারদের নেতৃত্বের কাছে হার মানতে হয় বর্ণচোরা রাজনীতিকদের।

জননেত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য ডা. হারিছ আলীকে অত্যন্ত মূল্যায়ন করতেন। এর একটি নজির উপস্থাপন করতে চাই। ডাক্তার সাহেব চাইতেন ছাতক পৌরসভা ঘোষণা এবং এর বাস্তবায়ন। ছাতককে পৌরসভায় রূপান্তরের পেছনে ডা. হারিছ আলীর অবদান স্মরণযোগ্য। জননেতা আবদুস সামাদ আজাদের মাধ্যমে তিনি বার বার প্রস্তাব দিয়ে আসছিলেন। শেষমেষ প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা কামনা করেন। এবং ১৯৯৮ সালে ডা. হারিছ আলীর সভাপতিত্বে ছাতকে অনুষ্ঠিত এক ঐতিহাসিক জনসভায় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রী জিল্লুর রহমান ছাতককে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা দেন।
ডা. হারিছ আলী একজন বহুমাত্রিক প্রতিভাদীপ্ত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনি একাধারে আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ, নিভৃতচারী কবি, প্রগতিশীল সমাজ সংগঠক, শিক্ষানুরাগী ও সংস্কৃতিমনা প্রসন্ন হৃদয়ের মানুষ। বিলেতের উচ্চ ডিগ্রিধারী অভিজ্ঞ ডাক্তার হওয়া সত্তে¡ও তিনি ছাতকের মাটি ও মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন না শুধু তাঁদের সেবা করে সারাটি জীবন ‘মানুষ মানুষের জন্য’ মর্ম বাণীতে নিজেকে উজাড় করে অ¤øান হয়ে রইলেন।

ডা. হারিছ আলীকে স্মরণ করতে হলে তাঁর প্রজ্ঞা, মননশীল চর্চা, সততা, নির্ভীক সাহসিকতা ও স্নিগ্ধ দেশপ্রেম, প্রগতিশীল আদর্শকে লালন করে, চেতনায় ধারণ করে পথ চলতে হবে। তবেই তাঁর স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা রূপায়ন হবে।

লেখক : সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী যুবলীগের সদস্য