ডা. হারিছ আলী : আমার নেতা, আমার ‘ডাক্তার নানা’


শহীদুর লস্কর রুমেন

আমি তাঁকে ডাকতাম ‘ডাক্তার নানা’। আমার নানা আবদুল লতিফ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি। সেই সূত্রে আমাদের পরিবারের সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মার সম্পর্ক। প্রায়ই তিনি আমাদের বাসায় আসতেন, রাতে থাকতেন। আমার মা তাঁর জন্য রান্না করতেন। আমি দেখতাম আমার নানা এবং ডাক্তার নানা দু’জনে গল্প করছেন, আড্ডা দিচ্ছেন।

অন্যদিকে ছোটবেলা থেকেই আমি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ছাতক ডিগ্রি কলেজে অধ্যয়নকালীন আমি পুরোপুরি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। সেই সময় নানা বিলাতের প্রবাসজীবন শেষে দেশে ফিরেছেন। সিলেট এবং ছাতকের বিভিন্ন স্থানে যেমন ছাতকবাজার, গোবিন্দগঞ্জ, ধারনবাজার, জাউয়াবাজার ইত্যাদি স্থানে চেম্বার খুলে ছাতক-দোয়ারার মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বিলাতি ডিগ্রি নিয়ে নানা আর দশজন ডাক্তারের মতো সিলেট শহরে বসেই মাসে লাখ লাখ টাকা কামাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে ডাক্তার নানা ছুটে গেলেন এলাকার গরিব মানুষের দোরগোড়ায় তাদের সেবা করতে। আমার জানা নেই এমন কোনও ডাক্তারেরÑযিনি বিলাতি ডিগ্রি নিয়ে গ্রামের বাজারে বসে সাধারণের চিকিৎসা করছেন। শুধু চিকিৎসা নয় বলা যায় প্রায় ফ্রি-চিকিৎসা। তাঁর চেম্বার ছিল সকল মানুষের জন্য অবারিত। রোগীদের কাছ থেকে ফিস নেওয়ার জন্য ডাক্তার নানার চেম্বারে কোনও সহকারীও ছিল না।

ছাতক কলেজে পড়াকালীন আমি ডাক্তার নানার সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি। নানা তখন ছাতক-আওয়ামী লীগকে শক্তিশালীকরণের জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করছেন। ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে আমরা ডাক্তার নানার পরামর্শ-উপদেশ মতো দলীয় কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাই।

নব্বইয়ের দশকে আমি ছিলাম থানা ছাত্রলীগের সভাপতি। কিন্তু কেন্দ্রীয় এক নেতা একদিন বললেন, ‘তুমি তো সভাপতি হতে পারবে না।’ জানতে চাইলাম কেন? তিনি বললেন, ‘কারণ ডাক্তার তোমার নানা। অন্য কেউ যদি তোমার নানা হত তাহলে কোনও সমস্যা ছিল না।’ আমি ডাক্তার নানাকে সেই ঘটনা বললাম। ডাক্তার নানা মজা করে বললেন, ‘তাহলে তাঁকেই এখন থেকে নানা ডাকতে শুরু কর।’

বিলাতে চলে আসায় নানার সঙ্গে কাজ করার আর সুযোগ ছিল না। বঞ্চিত হই তাঁর মেধা, প্রজ্ঞার ছোঁয়া এবং জ্ঞানগর্ভ উপদেশ থেকে। তবে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। আমরা সবাই চেয়েছিলাম ডাক্তার নানা ছাতক-দোয়ারা আসনে নির্বাচনে প্রার্থী হবেন। আমাদের সে আশা পূরণ হল না। ডাক্তার নানা এমপি-মন্ত্রী না হয়ে আজীবন ছাতক-দোয়ারাবাসীর যে সেবা করে গেছেন, এমপি-মন্ত্রী হলে এলাকাবাসীর জন্য কী করতেন তা সহজেই অনুমেয়। আমাদের কপাল খারাপ। আমরা ব্যর্থ হলাম তাঁর মেধা, প্রজ্ঞার পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে।

নানার কাছেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি। তিনিই ছিলেন ছাতক-দোয়ারার আমার মতো তরুণ কর্মীদের গুরু, শক্তি, প্রেরণার উৎস। সবশেষে আমার কামনা আমরা ছাতক-দোয়ারার মানুষ যেন তাঁকে ভুলে না যাই। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে আমাদের সম্মিলিতভাবে এলাকায় কিছু করা উচিত। যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সেটা দেখে অনুপ্রাণিত হতে পারে।

লেখক : সাবেক ভিপি, ছাত্রসংসদ, ছাতক ডিগ্রি কলেজ