এক বিস্ময়কর পুরুষ


আখতার আহমদ

এরশাদবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, সরকার গদি রক্ষায় মরিয়া, সারাদেশে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে প্রেরণসহ নানাভাবে জুলুম নির্যাতন করে যাচ্ছে। বিশেষ করে দেশের পুরোনো রাজনৈতিক দল মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এরশাদ সরকার যেন এক অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ছাতক উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতারা রেহাই পাননি। ছাতক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে ডা. হারিছ আলী সাহেব ছাতক থানার ওসির সঙ্গে দেখা করলেন এবং বললেন, নেতাকর্মীদের অহেতুক হয়রানি না-করার জন্য। ওসি সাহেবের সঙ্গে কথোপকথনের এক পর্যায়ে ডা. হারিছ আলী উত্তেজিত হয়ে পড়লেন এবং দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, আর যদি তাঁর নেতাকর্মীদের হয়রানি করা হয়, তবে তিনি যদি নির্দেশ দেন তবে ছাতক উপজেলাকে অচল করে দেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। আরও কিছু কঠিন কথা বললেন, পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে তা এখানে তুলে ধরা গেল না। তাঁর সেদিনের সেই লিডারশিপ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের মনোবলকে চাঙ্গা করে তোলে।

১৯৯০ সালের উপজেলা নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জনাব ডা. হারিছ আলীকে মনোনীত করা হয়। বিভিন্ন কারণে অনেক দলীয় নেতাকর্মী বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন। কিন্তু আমরা ডা. হারিছ আলীকে ভালোবেসে দলীয় সিদ্ধান্তে অনড় থেকে তাঁর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাই। তাঁর এই নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে এই বড় মাপের মহান ব্যক্তির সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়। মাসব্যাপী নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে এই বিরল ব্যক্তিত্বকে কাছ থেকে দেখেছি। তাঁর পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়েছি। জাউয়াবাজারে ডা. হারিছ আলীর নির্বাচনী প্রতীক বাসগাড়ির সমর্থনে সর্বশেষ নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন, আমার এই ক্ষুদ্র রাজনৈতিক জীবনে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে ঢাকা এবং সিলেটে অনেক বক্তার বক্তব্য শুনেছি কিন্তু সে দিন তিনি যে ভাষণটি দিয়েছিলেন তা আমার কাছে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে উৎসবমুখর পরিবেশে সর্বশেষ বক্তা হিসেবে ডা. হারিছ আলী যখন বক্তব্য দিতে মঞ্চে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন তখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। প্রকৃতিতে এক শান্তভাব পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। তখন গুরু গম্ভীর সুমধুর কণ্ঠে ডা. হারিছ আলী বলে উঠলেন, ‘প্রিয় জাউয়াবাসী ও ছাতকবাসী আস্সালামু আলাইকুম। আমি আজ নির্বাচনী প্রতীক বাসগাড়ির সমর্থনে আপনাদের কাছে ভোট চাইতে এখানে হাজির হয়েছি। আপনারা দূরদূরান্ত থেকে এখানে কষ্ট করে এসেছেন। আমার ও আমার দলের পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

প্রিয় জাউয়াবাসী আমি আপনাদেরই ভাই, আপনাদেরই সন্তান, আপনাদেরই বন্ধু; এখানকার আলো-বাতাস প্রকৃতি-পরিবেশ আমাকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আপনাদের কোলে কাঁখে আমি মানুষ হয়েছি। আজ আমি ব্যক্তিগত জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত, আপনাদের কাছে আর কী চাইতে পারি? তাই আজ প্রিয় এলাকাবাসীর খেদমত করার জন্য আমি উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছি। আপনাদের কাছে ভোট চাইতে এসেছি।’ এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেকের মতো অত্যন্ত সুন্দর, সুললিত কণ্ঠে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। আর শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে তাঁর বক্তব্য শ্রবণ করছিলেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য ছাতকবাসীর দুর্ভাগ্য তাঁর মতো একজন মহান ও সুযোগ্য নেতাকে আমরা উপজেলার চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করতে পারিনি। এটা আমাদের বিশেষ দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কী।

এরশাদ সরকারের সময় জননেত্রী শেখ হাসিনা সিলেট সফরে আসবেন, নেতাকর্মীদের মাঝে সাজ সাজ রব। বৃহত্তর সিলেটের হাজার হাজার নেতাকর্মী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানাতে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উপস্থিত হয়েছেন। আমরাও একটা কার নিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওয়ানা হই। কারের মধ্যে হারিছ আলী সাহেব সিলেট জেলা ছাত্রলীগের একসময়ের সহসভাপতি মনিরুজ্জামান সেলিম, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বাবুল চৌধুরী ও আমি ছিলাম। যাত্রাপথে ডা. হারিছ আলী নেত্রীর সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর শাহাদতের পর লন্ডনে আওয়ামী লীগকে সংগঠিতকরণ, ব্যক্তিগতভাবে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার কথা তুলে ধরেন। আর আমরা তা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম। এক পর্যায়ে নেত্রী বিমানবন্দর থেকে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত শেষে হজরত শাহপরান (র.)-এর মাজার জিয়ারতের উদ্দেশে খাদিমনগর রওয়ানা হন। প্রচন্ড ভিড়ের কারণে আমরা খাদিমের অদূরে রাস্তার এক পার্শ্বে কার পার্কিং করে নেত্রীর অপেক্ষা করছি। একটু পরে খোলা জিপে করে গাড়ির বহর নিয়ে নেত্রী শহরের দিকে এগিয়ে আসছেন। রাস্তার দু-পার্শ্বে হাজারো জনতার অভিনন্দনের জবাব দিতে দিতে নেত্রী আমাদের কাছাকাছি চলে এলেন। ডা. হারিছ আলীর দিকে নেত্রীর চোখ পড়তেই তাঁকে মিষ্টি হেসে সালাম দিলেন, ডাক্তার সাহেবও নেত্রীকে অভিবাদন জানালেন। একটু পরেই অবুঝ শিশুর মতো বলে উঠলেন, দেখছ আমি যে বলেছিলাম নেত্রীর সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা, তা ঠিক কিনা।

অনেক চড়াই-উতরাই ত্যাগ তিতিক্ষা আর শত শহিদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলো। জননেত্রী শেখ হাসিনা আবারও সিলেট সফরে এসেছেন। রাতে সিলেট সার্কিট হাউসে অবস্থান করছেন। নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আমরা ছাতক উপজেলার আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সার্কিট হাউসে গেলাম। পুরো সার্কিট হাউস লোকে লোকারণ্য; সিকিউরিটির কড়াকড়ি। এক পর্যায়ে ডা. হারিছ আলী প্রচন্ড ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে বললেন, ‘যাও গিয়ে বলো ছাতকের ডা. হারিছ নেত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।’

যাক একসময় আমাদের ডাক পড়ল, আমরা তো আবেগাপ্লুত। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এই প্রথমবারের মতো খুব কাছাকাছি দেখব। আমরা রুমে প্রবেশ করলাম জননেত্রী শেখ হাসিনা সোফাতে বসা, ডা. হারিছ আলী সাহেব পাশে বসলেন। আমরা নিচে কার্পেটে বসে পড়লাম। আমাদের প্রিয় দুই নেতা পরস্পর কুশল বিনিময় করলেন। ডা. হারিছ আলী বললেন, ওরা আমার ছাতকের লোকজন। আমাদের বললেন পরিচয় দেবার জন্য। এক পর্যায়ে আমার পরিচয় দেবার পালা। আমি বললাম ছাত্রলীগের কর্মী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। নেত্রী আবারও জিজ্ঞেস করলেন কী বললে, আমি বললাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি ছাত্রলীগের কর্মী। নেত্রী খুশি হলেন। কিছুক্ষণ পর আমরা বেরিয়ে এলাম। ডা. হারিছ আলী সাহেবকে ধন্যবাদ। তাঁর বদৌলতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম।

ডা. হারিছ আলী সাহেব আমাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ‘বাবা দেখ এই দুনিয়া হচ্ছে কমপ্রোমাইজের জায়গা। কী করবা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নাও। মনে রাখবে তুমি কি তোমার স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা, ভাইবোনদের সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করে চলছ না।’ তাঁর এই প্রবোধে মনে শান্তি পেলাম।

২০০০ সালের শেষ দিকে জননেত্রী শেখ হাসিনা সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের ঢাকা গণভবনে ডেকেছেন। ডাক্তার সাহেবের নেতৃত্বে আমরা গণভবনে প্রবেশ করলাম। নেতৃবৃন্দ যার যার বক্তব্য উপস্থাপন করলেন, নেত্রী মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। ডা. হারিছ আলী ফ্লোর নিয়ে বক্তব্য পেশ করলেন। জননেত্রী খুবই মনোযোগ দিয়ে বক্তব্য শুনলেন, কিছু নোটও করলেন। এর মধ্যে ছিল জাউয়া কলেজকে এমপিও-ভুক্তিকরণ। রাজনৈতিক কারণে আমরা ঢাকাতে অবস্থান করছি। ব্যারিস্টার এম ইয়াহইয়া, ফজলু ভাই, সানাউর রহমান তালুকদার, পৌর মেয়র আবুল কালাম চৌধুরী প্রমুখ। দলীয় সিদ্ধান্তে আমরা ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত। ডা. হারিছ আলী সাহেব আমাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, ‘বাবা দেখ এই দুনিয়া হচ্ছে কমপ্রোমাইজের জায়গা। কী করবা দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নাও। মনে রাখবে তুমি কি তোমার স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবা, ভাইবোনদের সঙ্গে কমপ্রোমাইজ করে চলছ না।’ তাঁর এই প্রবোধে মনে শান্তি পেলাম। এবং আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ একটি উপদেশ পেলাম। গণভবনে জননেত্রী শেখ হাসিনার সামনে দলীয় জনপ্রতিনিধিদের অনিয়মের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য তুলে ধরলেন, এর সূত্র ধরে তৎকালীন জনপ্রতিনিধিদের শেখ হাসিনা ভর্ৎসনা করতে কুণ্ঠবোধ করেননি। কারণ ডা. হারিছ আলী কারও বিপক্ষে মিথ্যা বলতে পারেন না। আজ এমন সাহসী নেতার বড়োই অভাব। আজ অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে আমাদের প্রিয় ছাতক। পেশাগত জীবনে একজন স্বনামধন্য সুচিকিৎসক ছিলেন। চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিতরা লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তিনি টাকা উপার্জন করতে পারেননি। বিনা ফিতে হাজার হাজার রোগী দেখেছেন। ছাতকের আনাচেকানাচে ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্প করেছেন। মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর এই জনসেবাকে কবুল করুন। আমিন।

তাঁর মতো একজন অতি বড় মাপের মানুষ সম্পর্কে আমার মতো একজন সাধারণ লোক কী মূল্যায়ন করবে। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাব। ডা. হারিছ আলী সাহেবকে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা পদকে ভূষিত করার জন্য। মহান আল্লাহর দরবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমাদের এই প্রিয় নেতা ডা. হারিছ আলীর জান্নাত কামনা করি।

লেখক : মাওলানা; সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, সুনামগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ, ব্যবসায়ী