স্বাধীনতা পদক, তবে মরণোত্তর

ফজলুল হক

ডাক্তার মামার সঙ্গে ছিল আমার ভয়ের সম্পর্ক, তাঁর থেকে পালিয়ে দূরে থাকার আপ্রাণ চেষ্টার সম্পর্ক। স্নেহের সম্পর্ক কতটুকু ছিল বোঝানোর জ্ঞান বা বোঝার জ্ঞান কোনওটাই আমার নেই। তাঁর চোখ রাঙানো এবং ধমকের সঙ্গে পরামর্শ ও উৎসাহ নিয়ে আমার বেড়ে ওঠা, এগিয়ে চলা। তবে ভয়টুকু যখন একটু কমতে শুরু করেছে; আমি যখন তাঁর সামনে মোটামুটি নির্ভয়ে বসে কথা বলতে শুরু করেছি; এমনকী তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে দু-চার মিনিট বক্তৃতা পর্যন্ত করেছি তখন তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।

মারা যাওয়ার সময় বয়সের অনুপাতে মোটামুটি সুস্থ ও সবল ছিলেন তিনি। তথাপিও তাঁর চেম্বারে রোগীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের সময় গত বছর অগাস্ট মাসের কোনও একদিন আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে এ অসুস্থতা থেকে সেরে উঠবেন না অথবা এ পৃথিবী ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে যাবেন এমনটা হয়ত নিজেও ভাবেননি। আর আমরা তাঁর স্বজন ও সুহৃদরা তাঁর মৃত্যুসংবাদ শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। নির্মম নিয়তির কাছে আত্মবিসর্জন দিয়ে আমাদের কাঁদিয়ে এতিম করে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনিÑ২০ অগাস্ট ২০১৩। এ-ও যুক্তরাজ্য বেড়ানো শেষে দেশে ফিরে মাত্র তিন মাসের মধ্যে।

ডাক্তার মামা পড়াশোনা শেষ করে যুক্তরাজ্য ছেড়ে দেশে চলে যান আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে। এতদিন পর অফুরন্ত উদ্যম নিয়ে ফুরফুরে মেজাজে গত বছর লন্ডন বেড়াতে এসে তাঁর পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে মিশে তিনি ক’দিনের জন্য তাঁর ফেলে আসা যৌবনে ফিরে গিয়েছিলেন। নিদ্রা, বিশ্রাম, নাওয়াখাওয়ার পরোয়া নেই। বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের খুঁজে খুঁজে বের করে তাঁদের সঙ্গে খোশগল্পে মিলিত হন প্রতিদিন, প্রতিটি প্রহরে। পরের বছর আবার বেড়াতে আসবেন সবাইকে এমন আশ্বাস দিয়ে দেশে ফেরেন ব্যস্ত তিনটি মাস কাটিয়ে। আজ আর ফিরে আসা হবে না তাঁর, বিলেত-বাংলাদেশ কিংবা পৃথিবীর কোথাও।

মৃত্যুর দুঃসংবাদটি শুনে মনে হয়েছিল আমার হিমালয় পর্বত বিলীন হয়ে গিয়েছে। পাথর হয়ে গিয়েছিলাম মুহূর্তের জন্য। কী জানি কেন হাজারো ঘটনার মধ্য থেকে একটি ঘটনা মনে পড়ে গিয়েছিল বিশেষভাবে। আমার স্ত্রী ও ছেলেদের নিয়ে ক’বছর আগে তাঁর বাসায় বেড়ানো ও একত্রে বসে খাওয়ার ঘটনা। ওমরাহ পালন করে তাঁদের নিয়ে দেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম। মামার হুকুম মাফিক সময়মতো তাঁর বাসায় পৌঁছামাত্র আবেগাপ্লুত মামা, মামানিকে বার বার বলছিলেন ‘দেখ ফজলুর বড় ছেলে দেখতে ফজলুর মতো হয়েছে।’
আমরা এক টেবিলে একত্রে খেতে বসি। মামা নিজহাতে খরচ করেছেন আমার সন্তানদের খাওয়ানোর জন্য। শ্রদ্ধেয় মামানির যত্ন করে রান্না করা খাবারের আয়োজন দেখে পেট অনেকটা ভরে গিয়েছিল। খাওয়ার এক পর্যায়ে আমার বড় ছেলে পানি পান করবে এ জন্য গ্লাসের দিকে হাত বাড়ায়। মামা পানিতে একটু স্নেহ মিশিয়ে দেওয়ার জন্য আমার ছেলের দিকে গ্লাসটি এগিয়ে দিতে চান। লাসটিটি লাবিবের কোলে পড়ে গিয়ে তার প্যান্ট ভিজে যায়। ডাক্তার মামা হাসতে হাসতে বলতে থাকেন, ‘আজ আমি আমার নাতিকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিলাম, এ ঘটনার মাধ্যমে সে আমাকে স্মরণ করবে।’ জানি না এ ঘটনা আমার বড় ছেলের মনে আছে কি না। তবে আমার মুখ থেকে শোনা মামা সম্পর্কে অনেক কাহিনি আমার সন্তানদের ভোলার কথা নয়।

আমি তাদের বলেছি মামা কীভাবে আমাকে ডায়রিয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। আমি ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছি সংবাদ পাওয়া মাত্র মধ্যরাতে লুঙ্গি পরিহিত, গেঞ্জি গায়ে, চটিজুতা পায়ে স্যালাইন হাতে নিয়ে ডাক্তার মামা আমার খালার বাড়িতে চলে এসেছিলেন। সন্তানদের আমি আরও বলেছি আমার মলমূত্র পরীক্ষা করানোর জন্য মামা কীভাবে পায়ে হেঁটে জাউয়াবাজার থেকে আমাকে কৈতক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। অসুখ নির্ণয়ের জন্য আমার মায়ের পান খাওয়া মুখের জিহŸা তিনি কীভাবে চামচ দিয়ে পরিষ্কার করে পরীক্ষা করেছিলেন সে গল্পও আমি আমার সন্তানদের বলেছি। আমার মাকে তখন যেভাবে ধমকিয়ে ছিলেন আর আমার মা যেভাবে হেসেছিলেন সেটুকু অবশ্য বলিনি।

আমার মা খালারা ডা. হারিছ আলীর বোন এ জন্য অত্যন্ত গর্ববোধ করেন। কেন করেন পুরোমাত্রায় বুঝলাম গত বছর এক টকশোতে তাঁর কথা শুনে। যুক্তরাজ্যে বেড়ানোর সময় তাঁকে এক টকশোতে নিয়ে গিয়েছিলাম আমি। তিনি টকশোতে আর আমরা পাশের রুমে বসে টিভিতে তাঁর কথা শুনছি। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বলতে গিয়ে মামা যখন বললেন, ‘আমি আমার স্ত্রী সন্তানদের আমার বোনের বাড়িতে রেখে সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধে চলে গিয়েছিলাম।’ তখন আনন্দ ও গর্বে আমিও আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। চোখের জল সামলাতে আমাকে বেগ পেতে হয়েছিল। কারণ তিনি তখন আমাদের বাড়ির কথা বলছিলেন।

মামা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন বছরে দু-চারবার। ওই দিনগুলো ছিল আমাদের জন্য ঈদের দিনের মতো। তাঁর কোনও না কোনও বা একাধিক বন্ধু সঙ্গে নিয়ে আসতেন। মা কোন্ মোরগ বা হাঁস জবাই করবেন আর বাবা কোন্ কোন্ মাছ জোগাড় করবেন তা নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু করে দিতেন। এক কার্তিক মাসে তিনি তাঁর ভায়রা আহমদ নূর মামাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। জাউয়াবাজার থেকে কাঁচা রাস্তা, কাদা থেকে পা বাঁচানোর জন্য তাঁর পায়ে ওয়েলিংটন বুট। সেদিন আমার মা তাঁদের জন্য বহু পদের তরকারির সঙ্গে তৈলাক্ত ছোট টেংরামাছের তরকারি রান্না করেছিলেন। ওই তরকারি খেয়ে মামা আমার মাকে বললেন, ‘অনেক দিন পর ছোটবেলায় খাওয়া মাছের স্বাদের তরকারি দিয়ে আজ বেশ মজা করে খেলাম।’ আর আহমদ নূর মামাকে বললেন, ‘শোন আহমদ নূর আমার বোনেরা অনেক স্বাদের তরকারি রান্না করে।’ আমার মায়ের চোখে মুখে তখন লক্ষ টাকার লটারি জেতার আনন্দ।

পড়াশোনা শেষ করে তিনি যখন বাংলাদেশে ফেরেন আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দেব, বড় আমলা হব, এ ছিল আমার লক্ষ্য। সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। হঠাৎ একদিন সকালবেলা তাঁর বাসায় যাওয়ার জন্য তলব পেলাম। বিলম্ব না-করে গিয়ে দেখি আমার মাও সেখানে। কোনও ভূমিকা ছাড়াই ডাক্তার মামা বললেন, ‘তুমি যদি ঘুস না খাও তাহলে চাকরি করে বাংলাদেশে খেয়ে বাঁচতে পারবে না; তা না করে লন্ডন চলে যাও।’

তাঁর হুকুম না মানার সাহস না দেখিয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম। প্রস্তুতির অংশ হিসেবে হাইকমিশনে ভিসা পাওয়ার ইন্টারভিউয়ের পূর্বের দিন তাঁর বাসায় গেলাম পরামর্শ নেওয়ার জন্য। কীভাবে অফিসারকে মোকাবিলা করতে হবে, কীভাবে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে সব বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু অফিসার যদি আমাকে ভিসা না দেয় তাহলে কীভাবে তাকে কী বলতে হবে আমার মামার পরামর্শের সে অংশটুকু এখানে লিখব না। কারণ, ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ এখনও সিটিজেনশিপ বাতিল করে বউবাচ্চাসহ আমাকে বাংলাদেশে পাঠানোর অধিকার রাখে। অফিসার ও আমার সৌভাগ্য। তিন বার ইন্টারভিউ নিয়ে সে আমাকে স্টুডেন্ট ভিসা দিয়ে দেয়।

আমার মামা যেখানে গিয়েছেন সেখানেই মানুষকে সাহায্য করেছেন। ছাতকের বিভিন্ন অঞ্চলে চেম্বার করে গ্রামের সাধারণ মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন আজীবন সর্বক্ষেত্রে সর্বাত্মকরণে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন এবং শুধু চিনতেনই না তাঁরা তাঁকে দলের একজন নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে সম্মানের চোখে দেখতেন এটা ছিল তাঁর অহংকার।

মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন তিনি। এটা তাঁর জন্য কম নাকি বেশি প্রাপ্তি সেটা যাচাই করব আমরা যারা জীবিত; মৃত ডা. হারিছ আলী নন।

লেখক : শিক্ষক ও আইনজীবী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী