ডা. হারিছ আলী : একজন কিংবদন্তি

আহমেদ আবুল লেইস

‘‘A good leader can’t get too far ahead of his followers’ – Franklin D. Roosevelt-এর এই উক্তিটি আমার মনে হয় ডা. হারিছ আলীর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উদ্দেশে করে লেখা। তিনি তাঁর অনুসারীদের মাঝে এভাবেই বেঁচে থাকবেন। এই পৃথিবীতে অনেক মহান মানুষ আসে যায় যাঁদের নামের পূর্বে বিশেষণের তেমন প্রয়োজন নেই। ব্যক্তিত্ব, সততা, শিক্ষা, যোগ্যতা এবং সমাজের জন্য বহুমুখি কাজ ও সমৃদ্ধি অর্জনই তাঁদেরকে আপন মহিমায় যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখে মানুষের তরে স্বীয় অবদানের জন্য। তেমনই একজন রাজনীতিবিদ সমাজ বিনির্মাণের কারিগর শিক্ষাবিদ এবং ছাতক-দোয়ারা তথা সুনামগঞ্জ এবং সিলেটের রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রদূত ডা. হারিছ আলী।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছিলেন রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী। সুনামগঞ্জ থেকে ভবিষ্যৎ জীবন গড়ার যাত্রা শুরু করে হাইস্কুলে থাকাকালীন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তী পর্যায়ে এমসি কলেজে এবং সিলেট মেডিক্যাল স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্থায় আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, সিলেট মেডিক্যাল কলেজ বাস্তবায়ন আন্দোলন এবং গৌরবের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এতদঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রথম সারির নেতৃত্বে চলে আসেন। তিনি সাতের দশকে গোবিন্দগঞ্জ আবদুল হক স্মৃতি কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য লন্ডনে তহবিল সংগ্রহ করেন। লন্ডনে কয়েক বছর অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের দাবিতে জনমত গঠনসহ ইউকে আওয়ামী যুবলীগ-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ব্রিটেনে থাকাকালীন সেখানকার তরুণদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন এবং সেখানে জননেত্রী শেখ হাসিনার স্নেহভাজন ও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।

১৯৮২ সালে দেশে ফিরে গ্রামীণ জনপদে বিশেষ করে ছাতকের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চিকিৎসা সেবাসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধনের উদ্দেশ্যে নিরলস নির্মোহভাবে কাজ করতে থাকেন এবং আবারও ছাতকে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। তিনি ছাতক উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও আহবায়কের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন দীর্ঘদিন। বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসহ দেশের সেরা সামাজিক নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি জাউয়াবাজার ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তিনি ১৯৯০ সালে ছাতক উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হন এবং কয়েকবার সংসদ নির্বাচনের টিকিট পাওয়ার চেষ্টা করেও অর্থবিত্ত এবং তোষামোদির রাজনীতির কাছে পরাজয় বরণ করেন। তাঁর নিজের দল আওয়ামী লীগ তাঁর জীবদ্দশায় বহুবার ক্ষমতায় ছিল। তিনি ইচ্ছে করলে ক্ষমতা ব্যবহার করে অনেক ধন-সম্পদের মালিক হতে পারতেন যা আজকাল আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে অহরহ দেখা যায়। অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের জন্য জিরো থেকে হিরো মানে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া খুবই মামুলি বিষয়। আর যে মানুষটিকে স্ত্রীর মৃত্যুর পর সান্ত¡না দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সিলেটের বাসায় গিয়েছিলেন, সেই মানুষটি তাঁর জীবদ্দশায় কখনও তাঁর নিজের জন্য কোনও সুপারিশ নিয়ে নেত্রীর কাছে যাননি। ডাক্তার সাহেব উল্লেখযোগ্য কোনও সম্পদ তাঁর পরিবার ও সন্তানদের জন্য রেখে যেতে পারেননি। তাঁর নীতি ও আদর্শে তিনি আজীবন অটুট ছিলেন। কোনও ধরনের লোভ-লালসা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি।

কোন্দল ও নষ্ট রাজনীতি ডা. হারিছ আলীকে জীবিত থাকতে কিছু দিতে না পারলেও অবশেষে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে (২০১৪) সমগ্র সিলেটবাসীকে সম্মানিত করেছে জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার। দেশের জন্য ডাক্তার সাহেবের অসামান্য অবদানের কারণে তাঁকে তাঁর প্রাপ্য দিয়েছে। তিনি জীবিতাবস্থায় তাঁর দেশ সেবার পুরস্কার দেখে যেতে পারলে সেটা হত আরও অর্থবহ ও যথাযথ। যাহোক এই পুরস্কার প্রাপ্তি তাঁর অনুসারীদের ভালো কর্মে অনুপ্রাণিত ও উৎসাহ জোগাবে এটাই কাম্য।

এই বিশাল মনের নিরহংকারী ও ত্যাগী রাজনীতিবিদ মানুষটির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত থাকার কারণে অনেক মিটিং মিছিলে কাছ থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ হয়েছে। গোবিন্দগঞ্জ ট্র্যাফিক পয়েন্ট সংলগ্ন এক ফার্মেসিতে তিনি সপ্তাহে ২/১ দিন রোগী দেখতেন। সেই সুবাদে আমিও সময় পেলেই সহপাঠীদের নিয়ে রাজনীতি সচেতন ছাত্র হিসেবে তাঁর চেম্বারে যেতাম। তাঁর কাছ থেকে কিছু শিক্ষা সবক ও সমসাময়িক বিষয়ে দিঙ্নির্দেশনামূলক উপদেশ খুব মনোযোগ সহকারে শুনতাম। আমার নাম ধরে ডেকে বলতেন, ‘পড়ালেখা আগে রাজনীতি পরে।’ তাঁর এই চিরন্তন উক্তি আজও আমার মনে আছে।

ভাগ্য পরিবর্তনের সংগ্রামে উন্নত জীবন ও জীবিকার তাগিদে এক যুগের দীর্ঘ সময় প্রবাসী হওয়ার ফলে অনেকের মতো আমার সঙ্গেও ডা. হারিছ আলীর যোগাযোগের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। কিন্তু ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ডাক্তার সাহেব লন্ডনে এসেছিলেন সম্ভবত তাঁর প্রিয় মানুষগুলোর কাছ থেকে সর্বশেষ বিদায় নিতে। তখন কোনও একজন নেতার সঙ্গে আলাপচারিতায় আমার প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি আমি কোথায় থাকি, কী করি এবং আমার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তৎক্ষণাৎ আমার মোবাইল ফোনে বেজে ওঠে তাঁর কণ্ঠস্বর, ‘কেমন আছ? আমি ডা. হারিছ আলী, চিনতে পারছো?’ তখনও আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে, তিনি আমাকে ফোন করবেন।

এত সহজসরল গুণী রাজনীতিবিদ আজকাল পাওয়া খুবই কঠিন। তাঁর মতো বরেণ্য নেতা ছাতকে ও সুনামগঞ্জে আর জন্মাবে কি না আমার সন্দেহ হয়। কিছু না পাওয়ার বেদনা কখনও তাঁর মধ্যে ছিল না, শুধু দিয়েই গেলেন। ডা. হারিছ আলীর মতো ব্যক্তিকে নিয়ে লেখা শুরু করা যায়, কিন্তু শেষ করা যায় না। তাই উপসংহারে আমি শুধু বলব, ‘তুমি বাঁচবে তোমার কর্মে হে বীর সেনা। তোমায় জানাই লাল সালাম। তুমি অমর ও অ¤øান।’

লেখক : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, গোবিন্দগঞ্জ আবদুল হক স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ ছাত্র সংসদ, ছাতক, সুনামগঞ্জ